নিউজ ডেস্ক: কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর লাশের দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে কী থাকছে, সেটাই এখন সবার জিজ্ঞাসা। প্রথম দফার ময়নাতদন্ত নিয়ে প্রশ্ন ওঠার কারণে পরের দফার ময়নাতদন্তের ওপর এই হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনের অনেক কিছু নির্ভর করছে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমানও বলেছেন, প্রথম ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন অনেক প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। দ্বিতীয়টাতে তেমনটা হবে না বলে তিনি আশা করেন। বৃহস্পতিবার কুমিল্লায় সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, প্রথম ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন অন্য খাতে নেওয়ার চেষ্টা হয়ে থাকলে এর সঙ্গে জড়িত সবাইকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। তিনি বলেন, তনু হত্যার প্রকৃত অপরাধীকে ন্যায়বিচারের আওতায় আনা হলে সবার ভাবমূর্তি উন্নত হবে। কোনো জজ মিয়া নাটক বা ঘটনা ভিন্ন দিকে নেওয়া হলে তা কেউ গ্রহণ করবে না।
প্রসঙ্গত, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় জজ মিয়া নামে নোয়াখালীর নিরীহ এক যুবককে গ্রেপ্তার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়া হয়েছিল। পরে বিষয়টি সাজানো বলে প্রমাণিত হয়, যা জজ মিয়া নাটক হিসেবে পরিচিতি পায়।
এদিকে দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্তকারী তিন সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গতকাল সকাল ১০টার দিকে কুমিল্লা সেনানিবাসে যায়। বোর্ডের সদস্যরা তনুর লাশ উদ্ধারের স্থানটি পরিদর্শন করেন। মেডিকেল বোর্ডের প্রধান কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. কামদা প্রসাদ সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের সেনাবাহিনী ডাকেনি। আমরা নিজ তাগিদে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। যেকোনো বিষয়ে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা যায়।’ কবে নাগাদ ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন দেবেন? এর জবাবে কামদা প্রাসাদ সাহা বলেন, সেটা নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। কারণ, এখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে।
সেনানিবাসের ওই ঘটনাস্থলে যান জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানও। এ সময় তিনি সেখানকার কর্মকর্তারা ছাড়াও তনুর মা-বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলেন। পরে বেলা দেড়টার দিকে তিনি কুমিল্লা সার্কিট হাউসে এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন।
কুমিল্লা সেনানিবাসের কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে মিজানুর রহমান বলেন, তাঁরা আশ্বাস দিয়েছেন, ন্যায়বিচারের স্বার্থে মামলার তদন্তে পূর্ণ সহযোগিতা করবেন। তিনি বলেন, ‘এতে করে একটি বার্তা হলো, যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে, তাতে আমরা এবং তারা—এই বিভেদ করা প্রত্যাশিত হবে না। এটি হচ্ছে অপরাধী ও ন্যায়বিচারপ্রার্থী—এ দুই ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। এর বাইরে বিভেদ সৃষ্টি জাতির স্বার্থে কাম্য নয়।’
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, ‘দ্বিতীয়বার যখন ময়নাতদন্ত হয়, তখন সংগত কারণেই জনমনে প্রশ্ন দেখা দেয় যে এত দ্রুত কেন দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্ত করা হচ্ছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন থেকে আমরা মনে করেছি, দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্তের প্রয়োজন ছিল। কেননা, প্রথম ময়নাতদন্তের সম্পূর্ণ রিপোর্ট যদিও এখনো উপস্থাপিত হয়নি, কিন্তু প্রিলিমিনারি যে রিমার্কস, তাতে আরও অনেক প্রশ্নের উদ্রেক করে। এবং সেই রিপোর্টটি আসলে সঠিক কি না, সেটি কিন্তু বিবেচনার দাবি রাখে। তাই আমরা মনে করি, দ্বিতীয় যে ময়নাতদন্ত হয়েছে, সেটি যেন বাড়তি কোনো প্রশ্নের উদ্রেক না করে, বরঞ্চ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া আবশ্যক। ন্যায়বিচারের স্বার্থে সে কাজটি করা হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।’
অধ্যাপক মিজানুর রহমান আরও বলেন, ‘সিআইডি ও বিচার বিভাগের প্রতি আমাদের আহ্বান থাকবে, যে বা যারা প্রথম ময়নাতদন্তের রিপোর্টকে কোনো না কোনোভাবে অন্য খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করে থাকে, কেবল তারা নয়, যারা ওই রিপোর্ট তৈরিতে সাহস জুগিয়েছে বা বাধ্য করেছে বা কোনোভাবে উৎসাহিত করেছে, সবাইকে বিচারের আওতায় আনা উচিত। ন্যায়বিচারের স্বার্থে আমরা এই দাবিটি রাখতে চাই।’
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, ‘অনেক সময় সাক্ষ্য-প্রমাণ টেম্পার বা ডক্টরিন করা হয়ে থাকে। যদি কেউ তদন্ত ভিন্ন খাতে নিতে বা বিচার বাধাগ্রস্ত করতে এমন কিছু করে থাকে, তাদেরও বিচারের আওতায় আনা দরকার। তিনি বলেন, বিশেষ করে যে জায়গায় তনুর মৃতদেহ পড়ে ছিল, তা এখন পরিষ্কার করা হয়েছে। মাটি তোলা হয়েছে। ঘটনাস্থলের অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। সাক্ষ্য আইন অনুযায়ী সেটা কাঙ্ক্ষিত নয়।’
ন্যায়বিচারের নামে বা তথ্য সংগ্রহের নামে তনুর বিপর্যস্ত পরিবারকে যাতে হয়রানির স্বীকার হতে না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে সবার প্রতি আহ্বান জানান মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান। এক প্রশ্নের জবাবে মিজানুর রহমান বলেন, মধ্যরাতে কেন তনুর বাবা-মা ও ভাইকে র্যা ব নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, তা জানার অধিকার দেশের মানুষের আছে। কমিশন এটি জানতে চাইবে। তিনি বলেন, যেখানে ঘটনাটা ঘটেছে, সেটা একটা বিশেষ এলাকা। সর্বসাধারণের প্রবেশে বিধিনিষেধ আছে। এই বিধিনিষেধ যেন তদন্তে বাধা তৈরি করতে না পারে। তদন্ত দলকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে।
এই মামলার তদন্ত-তদারক কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার নাজমুল করিম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, সিআইডি শুরু থেকেই এ ঘটনার ছায়া তদন্ত করে আসছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানার পর তারা পুরোদমে কাজ শুরু করেছে।
গত ২০ মার্চ রাত সাড়ে ১০টায় কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনুর লাশ কুমিল্লা সেনানিবাসের ভেতরে পাহাড় হাউসের অদূরে কালভার্টের পাশের ঝোপের মধ্যে পাওয়া যায়।
সূত্র: প্রথম আলো

Be the first to comment on "জজ মিয়া নাটক হলে কেউ গ্রহণ করবে না-কুমিল্লায় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান"