নিউজ ডেস্ক: ‘অন্যের গবেষণাকর্ম নিজের বলে চালিয়ে দেওয়া’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের সালমা বেগম নামে ওই শিক্ষকের একটি বই এবং ছয়টি আর্টিক্যালের প্রতিটিতে মিলেছে ‘চৌর্যবৃত্তির’ প্রমাণ।
খোদ নিয়োগ কমিটির এক সদস্য তার এই চৌর্যবৃত্তি নিয়ে আপত্তি বা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছিলেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এর আগে ২০১৩ সালেও একই শিক্ষকের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ উঠলে পদোন্নতি আটকে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
সেবার তদন্ত কমিটির কাছে অভিযোগ স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনাও করেছিলেন সালমা বেগম।
সম্প্রতি সালমা বেগমসহ সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের তিনজন সহযোগী অধ্যাপক পদোন্নতির জন্য আবেদন করেন, যা চূড়ান্ত করতে মঙ্গলবার দুপুরে অনুষ্ঠিত হয় ‘অধ্যাপক’ নিয়োগ কমিটির সিলেকশন সভা।
পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট এই নিয়োগ কমিটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ছাড়াও ছিলেন আরও চার জন।
তারা হলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ মিজান উদ্দিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ, সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক কামরুল আহসান চৌধুরী এবং একই বিভাগের অধ্যাপক সাদেকা হালিম।
কমিটির ওই সভায় সালমা বেগমের বিরুদ্ধে বই ও আর্টিক্যালে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ তুলে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেন অধ্যাপক সাদেকা হালিম।
নিয়ম অনুযায়ী, নিয়োগ কমিটির কোনও সদস্য ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিলে ওই অভিযোগ নিয়ে তদন্তের আগে সে ব্যাপারে সুপারিশ করা বেআইনি।
তবে সালমা বেগমের ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি; আপত্তি উপেক্ষা করেই ওই শিক্ষককে পদোন্নতি দেওয়ার সুপারিশ করেন কমিটির বাকি সদস্যরা।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ‘অধ্যাপক’ পদে পদোন্নতির জন্য সালমা বেগম তার লেখা যে বই ও ছয়টি আর্টিক্যাল জমা দিয়েছিলেন তা বিভিন্ন বই, অন্যদের গবেষণাপত্র এবং ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া বিভিন্ন প্রতিবেদনের অনুলিপি।
ওই শিক্ষক পদোন্নতির জন্য জমা দিয়েছিলেন বিশ্বসাহিত্য ভবন নামে প্রকাশনী থেকে ২০১৫ সালে প্রাকশিত তার বই ‘অ্যান ওভারভিউ অন ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিক্যাল সিস্টেম অব বাংলাদেশ’।
বইটিতে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত ‘ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি ফর দ্য ডেভেলপমেন্ট অব স্ট্যাটিসটিক্স (এনএসডিএস)’ গবেষণা প্রতিবেদনের বিভিন্ন পৃষ্ঠা ও অনুচ্ছেদ হুবহু তুলে দেওয়া হয়েছে।
এ ক্ষেত্রে তিনি কোনও তথ্য সূত্র বা রেফারেন্সও উল্লেখ করেননি।
এনএসডিএসের ৩৫ থেকে ৩৮ পৃষ্ঠার লেখার সঙ্গে সালমার বইয়ে প্রকাশিত ১০৮ থেকে ১১৪ পৃষ্ঠার লেখা অবিকল। এছাড়া ৬০-এর সঙ্গে ১৪৫-১৪৭, ৬৩ এর সঙ্গে ১৪৯ ও ১৫৬, ৬৪ পৃষ্ঠার সঙ্গে ১৫০ ও ১৫১ এবং ৮২, ৮৩ ও ৮৯ পৃষ্ঠার সঙ্গে ২২০ ও ২২১ পৃষ্ঠা মিলে যায়।
এনএসডিএস গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরির সময় অন্য দুই জনের সঙ্গে সালমা বেগম কনসালট্যান্ট ছিলেন।
মেধাস্বত্ব আইন অনুযায়ী, ওই প্রতিবেদনের স্বত্ব পরিসংখ্যান ব্যুরোর। আর এ কারণেই নিজের বইয়ে ওই সূত্র উল্লেখ ছাড়া তা তুলে দেওয়ার কোনও অবকাশ নেই।
নিয়োগ কমিটিতে সালমা বেগমের জমা দেওয়া আর্টিক্যাল ঘেঁটেও পাওয়া গেছে চৌর্যবৃত্তির নানা প্রমাণ।
‘হেলথ, ডিসকোর্স অ্যান্ড সোসাইটি: অ্য সোসিওলোজিক্যাল ওভারভিউ’ শীর্ষক আর্টিক্যালের সঙ্গে সিডও ফ্যাক্টশিট নং ২৩ এর ‘হার্মফুল ট্র্যাডিশনাল প্র্যাকটিসেস অ্যাফেক্টিং দ্য হেলথ অব উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন’, ‘এডওয়ার্ড সাঈদ: এন ইভালুয়েশন অব হিজ কন্ট্রিবিউশন টু পোস্ট কলোনিয়াল স্টাডিজ’ এর সঙ্গে পিটার মারকিউজের লেখা ‘সাঈদ’স অরিয়েন্টালিজম: অ্য ভাইটাল কন্ট্রিবিউশন টুডে’ শীর্ষক আর্টিক্যালের ৮০৯-৮১১ পৃষ্ঠার মিল রয়েছে।
এছাড়া ‘দ্য ইন্টেলেকচুয়াল লাইফ অব সাঈদ’ শীর্ষক আর্টিক্যালের ১৩-১৭ পৃষ্ঠা, ‘ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড সোসিও-ইকোনমিক প্রোফাইলস অব দ্য চাইল্ড সেক্স ওয়ার্কারস ইন বাংলাদেশ: এন ওভারভিউ’ শীর্ষক আর্টিক্যালের ‘ইউএন ডকুমেন্ট অন চাইল্ড এবিউজ’, ‘সোসিওলোজি অব রিলিজিয়ন: ইটস মিনিং অ্যান্ড সিগনিফিক্যান্টস’ শীর্ষক আর্টিক্যালের সঙ্গে ‘সোসিওলজি: দ্য এসেনশিয়ালস’ বইয়ের ৩০০, ৩১৭-৩১৯ পৃষ্ঠার হুবহু মিল পাওয়া গেছে।
‘মডার্নাইজেশন অব বুড্ডিজম: কন্ট্রিবিউশন অব আমবাডকার অ্যান্ড দালাইলামা’ বইয়ের ১৩ পৃষ্ঠার এবং সোসিওলজি: আন্ডারস্ট্যান্ডিং অ্য ডাইভার্স সোসাইটি’ বইয়ের ৪৫৪, ৪৫৯ ও ৪৬০ নং পৃষ্ঠা হুবহু।
এছাড়াও মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি অব নন-প্রফিট অর্গানাইজেশন: ভিওসডি এক্সপেরিয়েন্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক আর্টিক্যালটি একটি ওয়েবসাইট থেকে এবং ‘উইমেন অ্যান্ড চাইল্ড ট্রাফিকিং অ্যান্ড দেয়ার এনগেজমেন্ট ইন কমার্শিয়ালি এবিউজড প্রফেশন, নলেজ, ইনসিডেন্স অ্যান্ড পার্পেট্রেইটরস’ শীর্ষক আর্টিক্যালের সঙ্গে ‘চিলড্রেন ইন অ্যাগোনি: অ্য সোর্স বুক’ বইয়ের ৫২ নং পৃষ্ঠা এবং একটি ওয়েবসাইটের তথ্যের হুবহু মিল পাওয়া গেছে।
এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে সালমা বেগমের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তার মোবাইলটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিভাগের একাধিক শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সালমা বেগমের পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। সালমা বেগম থিসিস সম্পন্ন করেন বিএনপি-জামায়াতপন্থি শিক্ষক অধ্যাপক কামরুল আহসান চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে, যিনি মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত নিয়োগ কমিটির সদস্য ছিলেন।
এমনকি নিয়ম থাকলেও সালমার পিএইচডি থিসিস নিয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে কোনও সেমিনার হয়নি বলেও তারা জানিয়েছেন।
এদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে সালমা বেগম ‘অধ্যাপক’ হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন একাধিক সিন্ডিকেট সদস্য।
নিয়োগ কমিটির সদস্য অধ্যাপক সাদেকা হালিম জানান, “গবেষণা চুরি করে নিজের নামে চালানো নৈতিক অবক্ষয়ের লক্ষণ।
“২০১৩ সালেও তার বিরুদ্ধে একই অভিযোগ ওঠার পর আমরা মনে করেছিলাম সালমা বেগম নিজেকে সংশোধন করবেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে আবারও গবেষণা চুরির অভিযোগ পাওয়া গেছে, যা সমস্ত শিক্ষকের জন্য মানহানিকর।”
গুরুতর অভিযোগের পরও সালমা বেগমের পদোন্নতির বিষয়ে কথা বলতে উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এই প্রতিবেদককে বুধবার দেখা করার পরামর্শ দেন।
সূত্র: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Be the first to comment on "‘চৌর্যবৃত্তি করে’ ঢাবি শিক্ষকের পদোন্নতি"