নিউজ ডেস্ক : ৩০ বছর আগে যখন আমার মা মারা যান তখন আমি আবিষ্কার করি যে আমি তাকে যেমন ব্যক্তি বলে জানতাম তিনি আসলে তেমন ছিলেন না। এই সদানন্দ, সজীব, প্রেমময়ী নারী নিজেই নিজের জীবন সংহার করেছেন শুনে আমি প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খাই। এরপর আমি যখন আবিষ্কার করি তিনি আমার জন্মের আগে থেকেই জীবনভর উদ্বেগনিরোধক ওষুধ খেয়েছেন তখন আমার মধ্যে তার সম্পর্কে যে ধারণা ছিল তা আমূল বদলে যায়।
লোকে আসলে রহস্যে পরিপূর্ণ। যখন আমি আমার ছোট্ট মেয়েদের মনে কী খেলা করছে তা বুঝতে চেষ্টা করি আমি যেন একটি পাথরের দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খাই।
আর কোনো সমস্যা অন্যের কাছে প্রকাশ করলেই যে তা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে তেমনটা ভাবাও ঠিক নয়। ‘কোনো সমস্যা অন্যের সঙ্গে বললে তা অর্ধেক হয়ে আসে’- এ কথাটি একবার আমি আমার এক সন্তানকে বলি। কিন্তু সে এর জবাবে বলে গোপন কিছু প্রকাশ করা বিষ্ঠা নিয়ে ঘাটাঘাটি করার মতো।
পারিবারিক জীবনের হৃদয়ে থাকবে অসংখ্য গোপনীয়তা। তথাপি আমরা এই দিবাস্বপ্ন দেখতে অভ্যস্ত যে, আমরা এমন একটি কাল্পনিক খুদে সমাজে বাস করতে পারব যেখানে আমরা হব খোলা বইয়ের মতো। সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে এবং পরস্পরের যত্ন-আত্তি করার মাধ্যমে জীবনযাপন করব।
কিন্তু শিশুরা যেমন বড়দের কাছে চিররহস্যময় তেমনই বড়রাও শিশুদের কাছে চিররহস্যময় হয়েই থাকে। আমাদের সকলের ভেতরই আছে একটি গুপ্ত এবং অনাবিষ্কৃত বিশ্ব বা জগত। নিজেদের এই জগতটি এমনকি আমাদের নিজেদের ব্যক্তিগত চৈতন্যের কাছেও অজানা!
এতে অবশ্য ভালোবাসতে কোনো সমস্যা হয় না। কারণ ভালোবাসা কোনো জ্ঞান না। ভালোবাসা হলো নিজেদেরকে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত এবং অংশ হিসেবে বিবেচনা করার অনুভূতি। কিন্তু সাধারণ জানাশোনা- লোকে কীভাবে চিন্তা করে, তারা কে, তাদেরকে কীসে পরিচালিত করে, কীসে তাদের সবচেয়ে বেশি ভয়- এই বিষয়গুলো আমাদেরকে ব্যাপকভাবে মোহাচ্ছন্ন করে রাখে।
এই জ্ঞানের পথে প্রতিবন্ধক হয় কীসে থাকে? ভাষায় কখনো এই জ্ঞান ধরা যায় না। আমার যা বলি তা অন্যরা যা শোনে তা থেকে আলাদা বা আমরা যা বুঝাতে চাই তা থেকেও হয়তো আলাদা। কারণ শ্রোতার ভেতরগত চৈতন্যে পৌঁছানোর আগে আমাদের এই কথা অসংখ্য ফিল্টারের মধ্য দিয়ে যায়। এই ফিল্টারগুলো হলো, আবেগ, অস্বীকৃতি, কল্পনাপ্রসুত চিন্তা। এবং দুজন ব্যক্তির মধ্যকার সব ধরনের বিকৃতির স্তর পেরিয়ে এই ফিল্টারিং বা পরিশোধন ঘটে।
ভাষা ছাড়াও যোগাযোগের আরো নানা উপায় আছে। স্বামী বা স্ত্রীর ক্ষেত্রে যৌনতা, স্পর্শ, দৈহিক ভাষা, স্বরভঙ্গি এবং নির্দিষ্ট ধরনের নীরবতা।
আসলে লোকে কীভাবে পরস্পরিক যোগাযোগ স্থাপন করে তা বুঝতে পারাটাই জীবনে সাফল্য বা ব্যর্থতার চাবিকাঠি। এটি যাপিত জীবনেরও একটি জরুরি বিষয়- কীভাবে আমরা আমাদের চারপাশের লোকদেরকে দেখাব আমরা কে? আমরা কি আসলেই আমাদের চারপাশের লোকদেরকে দেখাতে চাই আমার কে? আমরা নিজেরাই কি জানি আমরা আসলে কে?
নাটক এবং গল্প বলার জ্বালানি হলো গোপন বিষয়সমূহ। কারণ জীবন নিজেই গোপন জিনিসের ওপর দিয়ে চলে। আর এমন নয় যে আমার গোপনীয়তা পছন্দ করি বলেই এমনটা ঘটে। বরং গোপনীয়তা অবশ্যম্ভাবী, একে এড়িয়ে চলা সম্ভব নয়। আমরা শুধু গোপনীয়তাগুলোর সঙ্গে কীভাবে বাস করতে হবে তা শিখতে পারি। আমরা যদি এই বিভ্রান্তিতে বিশ্বাস করি যে জীবনে কোনো গোপনীয়তা নেই তাহলে কোনো বিশেষ ব্যক্তি সম্পর্কে আমরা যা জানি সে সম্পর্কে আমরা বিপজ্জনকভাবে অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠব। অন্তত আমার মায়ের মৃত্যুর পর আমার এমনটাই মনে হয়েছে।
লোককে পুরোপুরি বুঝতে হলে দরকার পরম সংবেদনশীলতা। সহানুভূতি সর্বোচ্চ মানবিক গুণ। আমি জানি যে আমার মধ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণে সহানুভূতি নেই। কারণ সম্ভবত আমি তা বহন করার ক্ষমতা রাখি না। আর তা ছাড়া আমরা যদি আমাদের ভালোবাসার মানুষদের- আমাদের সন্তান, আমাদের জীবন সঙ্গী বা সঙ্গিনীর ভেতরে গভীরভাবে তাকাই তাহলে আমরা যা দেখতে পাব তা হলো তাদের সীমাহীন অসহায়ত্ব।
এই অসহায়ত্বের আমাদের হৃদয় ভাঙ্গার মতো ক্ষমতা রয়েছে। পরদুঃখকাতরতা ছিল যিশুখ্রিষ্টের মহান গুণ। আর এর জন্য তিনি ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। এই ঘটনা আমাদেরকে বিষয়টি সম্পর্কে আমরা যতটা স্বীকার করতে প্রস্তুত তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু বলে।
সূত্র : দ্য গার্ডিয়ান
Be the first to comment on "পারিবারিক জীবনের হৃদয়ে থাকে অনেক গোপন বিষয়, যা মেনে নিতে হয়"