অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান: সদ্য ঘোষিত এবারের বাজেট দুইটি দিক থেকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তা হলো বাজেটের আয়তন এবং উচ্চাভিলাষী টার্গেট। আয়তনের দিক থেকে এই বাজেট খুব বড়। যার আকার ৩,৪০,৬০৫ কোটি টাকা। কিন্তু আমাদের অর্থনীতির বর্তমান যে আয়তন, সেদিক থেকে এই বাজেট খুব বেশি বড় নয়। নানা দিকে থেকে বাজেট বড় করার আরো সুযোগ রয়েছে। সরকারের বাজেট হচ্ছে মূলত রাষ্ট্রের কোন কোন খাতে টাকা ব্যয় করা হবে তার একটি হিসাব।
সরকারকে ব্যয় করতে হলে অবশ্যই আয় করতে হবে। আর সরকারের আয় করার পন্থা হচ্ছে কর। সরকারের করবহির্ভূত আয়ের খাত যেমন- বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত কল-কারখানা, ফ্যাক্টরিসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান চালিয়ে যে আয় হয়, তা অতি সামান্য। কারণ বেশিরভাগ রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে বলা হয় স্ট্রেট অন এন্টারপ্রাইজ। এগুলো লোকসানমূলক প্রতিষ্ঠান এই অর্থে যে, প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন সামাজিক দায়দায়িত্ব পালন করার পর তাদের আর আয় বলতে কিছুই থাকে না। উল্টো এই সব প্রতিষ্ঠানে ভর্তুকি দিতে হয়। আমাদের রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি ব্যাংকের পারফরমেন্স কোয়ালিটির পতন হয়েছে। ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের আয় আসা তো দূরের কথা, উল্টো প্রত্যেক বছর প্রতিষ্ঠানগুলো ভর্তুকি দিয়ে চালিয়ে রাখতে হচ্ছে। এছাড়াও সরকারের অসংখ্য খাত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা করে চলে। কিন্তু তারা বাণিজ্যিক বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা করে চলতে পারে না। যার ফলে এই সব প্রতিষ্ঠান লোকসানমূলক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
উক্ত বিষয়াদি বিবেচনায় সরকার যে অর্থ ব্যয় করবে, তার সর্বোচ্চ উৎস হচ্ছে কর। কার আদায় ছাড়া সরকারের বিকল্প কোনো পথ নেই। এ বছর করের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ কোটি ৪২ লক্ষ ৭৫২ কোটি টাকা। অবশ্য অন্যান্য খাত থেকে সামান্য কিছু আয় আসবে। তারপরও করই হচ্ছে আয়ের প্রধান উৎস। তাহলে দেখা যাচ্ছে আমাদের বাজেট ব্যয় থেকে ৯৭ হাজার ৮৫৩ কোট টাকা ঘাটতি রয়েছে। উপরোক্ত ঘাটতি ব্যাংকিং খাত, সঞ্চয়পত্র বিক্রিসহ অন্যান্যভাবে সরকার সংগ্রহ করবে। এর সাথে বৈদেশিক ঋণসহ আরো অন্যান্য বিষয় যুক্ত রয়েছে। মূল সংকট হচ্ছে আমাদের করের হিসাব নিয়ে। এখানে এই করের হার বিশ্বের অন্যান্য দেশের জিডিপি এবং করের অনুপাতের তুলনায় সর্বনিন্ম। পার্শ্ববর্তী ভারত, শ্রীলংকা এবং পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশে এই অনুপাত ২০ থেকে ৩২ শতাংশ পর্যন্ত। যা জিডিপি এবং করের অনুপাতে নির্ধারণ করা হয়। আর আমাদের দেশে এর অনুপাত ১০.৩ শতাংশ।
বর্তমানে আমাদের অর্থনীতির আকার বড়। প্রতিবেশী দেশের তুলনায়ও আমরা আরো বেশি কর আদায় করতে পারতাম। তা করা হলে আমাদের ঘাটতি বাজেট হওয়ার তো কথাই নয়, বরং বাজেটের আকারও আরো বড় হতে পারত। আমরা সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন রকমের সেবা চাই। যেমন আমরা যারা সাধারণ নাগরিক তারা সরকারের কাছ থেকে রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, স্কুলকলেজ, মাদ্রাসাসহ নানা ধরনের অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা চাই। ব্যবসায়ীরা নিরাপত্তাসহ ব্যবসা করার জন্য নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা চান। কিন্তু আমরা যেভাবে চাই, কিন্তু দেয়ার ব্যাপারে আমরা সেই পরিমাণ উদার নই। একটি অবিশ্বাস্য বিষয় হলো প্রায় ১৬ কোটি লোকের আমাদের এই দেশে মাত্র ১০ থেকে ১১ লক্ষ লোক আয় করেন। যা উন্নত দেশের লোকের কাছে কল্পকাহিনী বলে মনে হবে।
এবার বাজেটে খুব উচ্চাভিলাষী টার্গেট করা হয়েছে। বলা হয়েছে করদাতাদের সংখ্যা বাড়ানো হবে। করদাতাদের সংখ্যা হবে ১৫ লাখ। গত বছর করদাতাদের সংখ্যা ছিল ১০ লাখ। এর মধ্যে অনেক নামমাত্র করদাতা রয়েছেন। এক্ষেত্রে আমাদের কর আদায়ের ব্যবস্থাপনায় এক ধরনের সংকট রয়েছে। আমাদের করের ভিত্তি কী ? ব্যবসায়ীরা তাদের প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির আয়ের উপর যে করপোরেট ট্যাক্স দেন তা খুব উচ্চ মাত্রার। ট্যাক্স দেয়ার এই মাত্রার হার ৪৪ থেকে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত। এর ভিত্তি হিসেবে ধরেই নেয়া হয় ব্যবসায়ীরা সঠিক হিসাব দেন না। ব্যবসায়ীরা তাদের লাভের হিসাব গোপন করেন। অতি সামান্য অংশই তারা প্রকাশ করেন। যার কারণে অতি অল্প আয়ের উপর অতিমাত্রায় কর আরোপ করা হয়। অর্থাৎ আমাদের দেশে কর ব্যবস্থাপনার ভিত্তিই হচ্ছে অবিশ্বাস। এর অর্থ হলো কর আদায়কারী ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস করেন না। আমাদের যে অডিট পদ্ধতি রয়েছে, যেখানে হিসাব চার্টার্ট একাউন্ট দ্বারা নিরীক্ষা করার কথা ছিল, সেই হিসাবেও গোলমাল রয়েছে। সরকারি সংস্থাগুলো ব্যবসায়ীদের আয়ের হিসাবে আস্থাশীল নয়। ধরেই নেওয়া হয় তাদের আয়ে ফাঁকিবাজি রয়েছে। কাজেই যতটুকুই ব্যবসায়ীরা আয় হিসাবে প্রদর্শন করেন, যা তাদের মোট আয়ের সামান্য অংশ। তাদের এই সামান্য আয় থেকেই সরকারকে একটি বড় অংশ ট্যাক্স হিসাবে নিতে হচ্ছে। কিন্তু এটি একটি স্বাধীন এবং আধুনিক রাষ্ট্রে করের কোনো ভিত্তিই হতে পারে না।
এই জন্য আমি সুপারিশ করি আমাদের কর পদ্ধতিকে একটি যৌক্তিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে করপোরেট ট্যাক্স বা আয়করের যে ব্যবস্থা রয়েছে তার সাথে সামঞ্জস্যতা রেখে একটি যৌক্তিক ব্যবস্থা বাংলাদেশে কায়েম করতে হবে। অন্তত আমাদের সার্ক অঞ্চলে জিডিপি এবং করের যে অনুপাত রয়েছে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেটির একটি গ্রহণযোগ্য অনুপাত ধার্য করতে হবে। আমরা করপোরেট ট্যাক্স এতো উচ্চ মাত্রায় ধার্য না করে বরং তা কমাতে পারি। তবে তা নির্ভর করে অডিট সিস্টেমের সঠিকতার উপর। অর্থাৎ পাবলিক এবং প্রাইভেট লিমিডেট কোম্পানিসহ বিধিবদ্ধ নানা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অডিট সিস্টেম যদি যথাযথভাবে হয়, তাহলে করপোরেট ট্যাক্স কমানো যায়। কেউ যদি আয়ের এদিক সেদিক না করে এবং প্রকৃত আয় প্রকাশ করে সে ক্ষেত্রে তাদের আয়ের পরিমাণ বেশি যাবে। এমন ক্ষেত্রে তাদের আয় করের মাত্রা সহজেই কমিয়ে আনা যায়। একই ব্যবস্থা করা যেতে পারে ব্যক্তি মালিকানা আয় করের ক্ষেত্রে। ব্যক্তি মালিকানায় ২৫ শতাংশ আয়কর দিতে হয়। একজন লোকের নিকট এই পরিমাণ বেশি হয় এই কারণেই যে, ১০০ টাকা আয় করলেই তাকে ২৫ টাকা কর দিতে হবে।
আমি মনে করি, আয় গোপন করার এটি একটি অন্যতম কারণ। এক্ষেত্রে এক ধরনের ভীতি এবং মানসিক পীড়ন কাজ করে যে, ১০০ টাকা আয় করলে ২৫ টাকা সরকারকে দিয়ে দিতে হবে। একটি পর্যায় পর্যন্ত এর পরিমাণ স্বাভাবিক থাকুক। পরে কর কম ধার্য করতে হবে। মানুষ তাতে বেশি করে আয় প্রদর্শন করে। সে রকম একটি ব্যবস্থা গ্রহণ করলে প্রত্যেক বছর কালো টাকা সাদা করার কাহিনী আসবে না। আর এই কালো টাকা নিয়ে দুদকে মামলাসহ নানা ঘটনাই ঘটে যায়। এর কোনো কিছুই লাগবে না যদি অপ্রদর্শিত আয় কয়েক বছর পরও প্রদর্শন করা যায়। কিন্তু ট্যাক্স দিতে হবে ২৫ শতাংশ। ট্যাক্সের উপর আবার জরিমানা দিতে হবে ৫ শতাংশ। অর্থাৎ ৩০ শতাংশ টাকা সরকারকে দিয়ে দিতে হবে। যার কারণে এই টাকা কেউ দেখাচ্ছে না। ২০০৭ সালে সামরিক শাসনামলে অনেকের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়েছিল। সেগুলো আবার হাইকোর্টে টিকেনি। অর্থাৎ এর সাথে নানা কাহিনী রয়েছে। ফলে পুরো ট্যাক্স ব্যবস্থার মাঝে আমরা যদি পরিবর্তন আনতে পারি, যাতে তাহলে সমাজের প্রত্যেকে তার আয় দেখাতে পারে। সেজন্য করের হার কমাতে হবে। পানামা পেপারস কেলেঙ্কারিতে বাংলাদেশের অনেক ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের নাম রয়েছে। আরো অনেকের নাম হয় আসেনি। এছাড়া বিদেশে টাকা পাঠানোর মতো নানা বিষয় তো রয়েছেই।
একদিক থেকে আমরা যেমন চাই বিদেশীরা আমাদের দেশে বিনিয়োগ করুক, অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে প্রচুর টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। মালয়েশিয়া এমন কি ইউরোপ-আমেরিকাতেও আমাদের পুঁজি যাচ্ছে। সেটিকে ঠেকানোর জন্য সহজ আয় প্রদর্শনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। যাতে সহজে মানুষ আয় দেখাতে পারে এবং করের সহজ হার নির্ধারণ করতে হবে যেটা সহনীয় হয়। করদাতা যাতে মানসিক যাতনার মাঝে না পড়ে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। মূল কথা হলো কর ব্যবস্থাপনার মাঝে আস্থার জায়গা তৈরি করতে হবে। আমাদের অর্থনীতির দ্বিতীয় সংকট হচ্ছে বিনিয়োগের। আমাদের অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ জিডিপি ৩০ শতাংশ পর্যন্ত হারে হওয়ার কথা ছিল এবং আমরা তা প্রত্যাশাও করি কিন্তু বিনিয়োগ সেই হারে হচ্ছে না। বিশেষ করে বেসরকারি বিনিয়োগ কমে গেছে। গত ৫ বছর আগে তার পরিমাণ ছিল ২২.৫ শতাংশ। এখন বিনিয়োগ সেই পর্যায়ে আছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। বড় ধরনের শিল্প উদ্যোগ গত কয়েক বছরে দেখা যায়নি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যক্তিক পর্যায়ে বিনিয়োগ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে হয়েছে। আগে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কিভাবে আত্মসাৎ করা হয়েছে তা আমরা অনেকে জানি। ব্যাংক ঋণের টাকা বিভিন্ন দেশে পাচার করা হয়েছে। ব্যাংক এখন বেশি সচেতন হওয়ায় ঢালাওভাবে ব্যাংক থেকে ঋণ যেনতেনভাবে নেয়াও যাচ্ছে না এবং সেইভাবে আর আত্মসাৎও করা যাচ্ছে না।
আমার মনে হয় বিনিয়োগ কমে যাওয়ার কারণ হচ্ছে ব্যাংক থেকে টাকা লুটপাট করে নিয়ে যাওয়া বন্ধ হওয়া। যার প্রভাব বিনিয়োগের উপর পড়েছে। কিন্তু সূক্ষভাবে হিসাব করলে দেখা যাবে, প্রকৃত বিনিয়োগ কিন্তু কমেনি। এখন কম বিনিয়োগ এবং আগের বেশি বিনিয়োগের একটি ঋণাত্মক প্রবণতা বিনিয়োগের ঘাটতি নয়। এটা আসলে টাকা লুটপাট বন্ধ আছে এবং আগে ব্যাংক থেকে মানুষ যে হারে টাকা নিয়ে গেছে এখন আর সেই হারে নিতে পারে না। কিন্তু প্রকৃত বিনিয়োগ কমেনি বরং বেড়েছে। তা না হলে আমাদের জিডিপির উত্থান ৭.২ শতাংশ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ আপাত দৃষ্টিতে কম দেখা যাচ্ছে । ব্যাংক ঋণ কম দিচ্ছে। কিন্তু আগে ব্যাংক বেশি ঋণ দিয়েছে তা কিন্তু বিনিয়োগ হয়নি। বিদেশে পাচারসহ অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হয়েছে।
আর একটি বিষয় হচ্ছে অনানুষ্ঠানিক বিনিয়োগ। গ্রামেগঞ্জে গেলে দেখা যাবে, সেখানে বিভিন্ন ধরনের কর্মোদ্যোগ রয়েছে। যেমন পোল্ট্রি ফার্ম থেকে আরম্ভ করে হাঁসমুরগি, মৎস্য খামার, ফলমূল, আমের বাগান, লিচুর বাগানসহ বিভিন্ন ধরনের কৃষিনির্ভর ব্যবস্থা, সামান্য ব্যবসা, যান্ত্রিকীকরণ, রিকশা, ভ্যান, নৌকায় যন্ত্র লাগানো এবং কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ার কারণে বিনিয়োগ বাড়ছে। তারা ব্যাংক থেকে ক্ষুদ্র ঋণ কিংবা বিদেশ থেকে পাঠানো টাকা অথবা নিজেদের সংগ্রহের টাকা বিনিয়োগ করছে। এই সব কিছু মিলে অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রচুর বিনিয়োগ হচ্ছে। আমি মনে করি এই বিনিয়োগের হিসাব সামনে না আসার কারণে বিনিয়োগের পরিমাণ কম মনে হচ্ছে। পাবলিক সেক্টরে বিনিয়োগ বেড়েছে। সরকারের মেগা প্রজেক্টের কাজ যেমন পদ্মাসেতু, মেট্টোরেল, ফ্লাইওভার, বিভিন্ন রকমের বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ চলছে। এই সব কাজে আমাদের দেশীয় উপকরণ রড, সিমেন্ট, শ্রমিক, ইট, পাথর, বালি ব্যবহার হচ্ছে। এগুলো একটি গুণিতক প্রভাব পড়েছে। অর্থাৎ পাবলিক সেক্টরের বিনিয়োগ হলে তা প্রাইভেট সেক্টরকেও উজ্জ্বীবিত করে। আমি মনে করি সেটা হচ্ছে।
তবে শিল্পায়ন ছাড়া আমাদের কোনো বিকল্প নেই। শিল্পায়ন আমাদেরকে করতে হবে। এক সময় উচ্চ ব্যাংক সুদের হারকে শিল্পায়নের পথে প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে মনে করা হতো। কারণ ব্যাংক থেকে ১৫/১৭ শতাংশ হারে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করা একেবারেই সম্ভব ছিল না। বেশির ভাগ অর্থনীতিবিদ বলতেন, আমাদের দেশের বড় বিনিয়োগের বড় অন্তরায় হচ্ছে উচ্চ ব্যাংক সুদের হার। কিন্তু এখন এই সুদের হার কমতে কমতে ৮ থেকে ৯ এর ঘরে চলে এসেছে। কিন্তু তারপরও দেখা যাচ্ছে কাঙ্খিত হারে বিনিযোগ হচ্ছে না। সমস্যাটি এখানেই। এর মানে দাঁড়াচ্ছে আমরা এতো দিন যাবত যেটিকে মূল সমস্যা হিসেবে গণ্য করেছিলাম, আসলে সেটা কোনো সমস্যাই নয়। সমস্যা রয়ে গেছে অবকাঠামোগত খাতে। যে হারে আমাদের গ্যাস, বিদ্যুৎ দরকার আমরা তা সরবরাহ করতে পারছি না। জ্বালানি সংকট একটি বড় সংকট। সেখানে আমাদেরকে দ্রুত মনোযোগ দিতে হবে। আমাদের মেগাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প যেমন মাতারবাড়ি প্রকল্প এবং গ্যাসসংযোগ লাইন, বিদ্যুৎসংযোগের ব্যবস্থা করলে অবকাঠামোগত সমস্যা দ্রুত সমাধান হবে। এক সময় আমরা সুদের হারকে প্রধান অন্তরায় হিসেবে মনে করেছিলাম কিন্তু তা সঠিক নয়। এখন বিনিয়োগ বাড়াতে হলে অবকাঠামোগত দিকে প্রাধ্যান্য দিতে হবে। এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে আমাদের কর্মসংস্থানের সমস্যাটি সমাধান হয়ে যাবে। বিশেষ করে যারা শিক্ষিত বেকার তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
আমাদের আর একটি সমস্যা হচ্ছে কারিগরি শিক্ষার প্রসার কম। জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ মানবশক্তির অভাব আমাদের শিল্পায়নের ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা। কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকার ফলে দক্ষ মানবশক্তি গড়ে উঠছে না। বলা হয় আমাদের এখানে খুব সস্তায় শ্রম পাওয়া যায়। কিন্তু তারপরও দক্ষ জনশক্তির অভাববোধ এখানে প্রচণ্ড রকমের। প্রত্যেক বছর বিদেশে থেকে আমাদের ভাইবোনরা কষ্ট করে প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার পাঠান। কিন্তু আমরা কি জানি ৫ থেকে ৬ বিলিয়নের মতো ডলার বিদেশিদেরকে বেতন ভাতা হিসেবে দিয়ে দেই। গার্মেন্টস সেক্টরে আমাদের লক্ষ লক্ষ বোনেরা কাজ করেন। কিন্তু এই সেক্টরের উচ্চ পর্যায়ে কিন্তু বিদেশিরা কাজ করেন। এক দিকে আমরা অদক্ষ লোকদের বিদেশ পাঠিয়ে মরুভূমিতে কাজ করিয়ে যে অর্থসংস্থান হয়, তা থেকে ৫/৬ বিলিয়ন ডলার আমরা বিদেশিদের দেই। এ অবস্থায় দেশে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: জাগে নিউজ
Be the first to comment on "বাজেটে আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্যতা ও বাস্তবতা"