নিউজ ডেস্ক ॥ এ্যানোয়াল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (এডিপি) অর্থায়ন এবং কোভিট-১৯ প্রকল্পের আওতায় লোহাগড়া পৌরসভার অবকাঠামো উন্নয়নে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকার প্রকল্পে চলছে সীমাহীন অনিয়ম দুর্নীতি। প্রকল্প সমূহ হলো লোহাগড়ার সাবুতলা হইতে ডাক্তার পরিতোষ পালিত’র বাড়ির সামনে দিয়ে নবগঙ্গা নদী পর্যন্ত ২২৩ মিটার ইটের ড্রেন নির্মাণ। প্রকল্প ব্যয় ২৪ লাখ ৭৬ হাজার ৭৫২ টাকা। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ঐশ্বমী এন্টার প্রাইজ। রামপুর মহাসড়ক হইতে নিরিবিলি গেইট পর্যন্ত ২১৫ মিটার কার্পেটিং, ব্যয় ১৩ লাখ ৬১ হাজার ১৫০ টাকা। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সুফিয়া এন্টার প্রাইজ। লক্ষীপাশা টেলিফোন এক্সচেঞ্জ অফিস হইতে রেজাউল মাস্টারের বাড়ি পর্যন্ত কার্পেটিং, ব্যয় ২৪ লাখ ৭৮ হাজার ৯৬০ টাকা। ঠিকাদারী প্রাতষ্ঠান মেসার্স ফকির এন্টার প্রাইজ। গোপীনাথপুর হবি কামাল’র বাড়ি হইতে জাহিদুল ইসলাম ভিটোর বাড়ি পর্যন্ত ৩৮ মিটার ইটের ড্রেন নির্মাণ। লক্ষীপাশা গাল্স হাইস্কুলের গেইট হইতে নতুন ভবন পর্যন্ত ৮৪ মিটার ইটের সলিং। লক্ষীপাশা আদর্শ বিদ্যালয়ের বাই সাইকেল গ্যারেজ পর্যন্ত ইটের সলিং। ছাতরা ১৩৮ মিটার ইটের হ্যারিংবোন (এইচবিবি) চারটি প্যাকেজের মোট ব্যয় ১০ লাখ ৮৮ হাজার ৩৩৬ টাকা। ঠিকাদার মেসার্স ফকির এন্টার প্রাইজ। লোহাগড়া উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্স গেইট হইতে পাকা সড়ক পর্যন্ত ৩৭ মিটার কার্পেটিং। কুন্দসী মালোপাড়ায় ৫৩ মিটার ফ্লাট সলিং। লক্ষীপাশা কালি মন্দির সংলগ্ন রাস্তায় সিসি ঢালাই। এই তিনটি প্যাকেজের ব্যয় ৯ লাখ ৩৫ হাজার ৪৩৫ টাকা। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স ফকির এন্টার প্রাইজ। মাইট কুমড়া তিনটি প্যাকেজে হাসমতের বাড়ি হইতে জনির বাড়ি পর্যন্ত ৮৫ মিটার। লিংক রোড হইতে কবরস্থান ৩০ মিটার এবং কবরস্থান হইতে সামাদের বাড়ি পর্যন্ত ৩০ মিটার ইটের ফ্লাট সলিং, ব্যয় ৯ লাখ ৩৫ হাজার ৪৩৫ টাকা। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স ফকির এন্টার প্রাইজ। কোভিট-১৯ প্রকল্পের আওতায় লোহাগড়া বাজার ফলপট্টি হইতে লোহাগড়া পোষ্ট অফিস পর্যন্ত আরসিসি ড্রেন ও রাস্তা নির্মাণ, ব্যয় ৪৭ লাখ ৫৭ হাজার ১০ টাকা। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান- মেসার্স ফকির এন্টার প্রাইজ। লোহাগড়া স্বর্ণপট্টি হইতে জয়পুর ঈদগাহ সংলগ্ন ব্রিজ পর্যন্ত ৪৩৫ মিটার আরসিসি রাস্তা, ব্যয় ৭৭ লাখ ৮১ হাজার ৭০৫ টাকা। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান-বাবুল এন্ড মোল্যা জেবি। লক্ষীপাশা আল মারকাজুল মসজিদ হইতে সাইফুল ম্যানেজারের বাড়ি পর্যন্ত ৩৯০ মিটার কার্পেটিং, ব্যয় ৫০ লাখ ৩০ হাজার ৬০৩ টাকা। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স ইডেন প্রাইজ। লোহাগড়া থানার মেইন গেইট হইতে পল্লী বিদ্যুত অফিস অভিমুখী ৩৩০ মিটার কার্পেটিং এবং লক্ষীপাশা চৌরাস্তা হইতে থানা গেইট পর্যন্ত ৩ ফুট সাইড সম্প্রসারনসহ ১৪৫ মিটার চাষ দিয়ে কমপ্যাক ৪ ইঞ্চি ইটের পিকেটের পর ৪০ মিলিমিটার ড্রেস কার্পেটিং। থানা গেইট হইতে খেয়াঘাট ব্রিজ পর্যন্ত রাস্তার উভয় সাইড রিপেয়ারসহ ২৫ মিলিমিটার কার্পেটিং, যার ব্যয় ৭৯ লাখ ৭ হাজার ৫১৪ টাকা। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স ফকির এন্টার প্রাইজ। এই প্যাকেজের জন্য কাজের শর্ত সাপেক্ষে ইজিপি দরপত্র আহব্বান করা হলে মেসার্স ইডেন প্রাইজ এবং ফকির এন্টার প্রাইজসহ মোট ৬টি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা করেন। দরপত্রের শর্ত (টিডিএস) পূরণে ব্যর্থ হলেও অদৃশ্য কারণে মেসার্স ফকির এন্টার প্রাইজকে কাজের ওর্য়াক ওয়ার্ডার দেয় পৌর কর্তৃপক্ষ। এহেন অনিয়মের বিষয়টি তুলে ধরে চলতি বছরের ২৮ জুলাই প্রকল্প পরিচালক, লোকাল গর্ভনমেন্ট কোভিট-১৯ রেসপন্স এন্ড রিকভারি প্রজেক্ট (এলজিসিআরআরপি) বরাবর নড়াইলের ১ম শ্রেণীর ঠিকাদার রেজাউল আলম তার প্রতিষ্ঠানের প্যাডে দরপত্র পূন:মূল্যায়নের আবেদন করেন। আবেদনের নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই তড়িঘড়ি করে কাজ শুরু করেন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স ফকির এন্টার প্রাইজ। থানা গেইট হইতে পল্লি বিদ্যুত অফিস অভিমুখী রাস্তাটির বেড কাটার পর ৮ থেকে ১০ টন রোলার দিয়ে মাটি বসানোর পর কমপ্যাক ১০ ইঞ্চি বালু, এর ওপর ৫০ শতাংশ ইটের পিকেট খোয়ার সাথে ৫০শতাংশ বালু মিশ্রিত কমপ্যাক ৬ ইঞ্চি, তার ওপর শুধু এক নম্বর ইটের পিকেট কমপ্যাক ৬ ইঞ্চি। সর্ব শেষ ২৫ মিলিমিটার অর্থাৎ এক ইঞ্চি ড্রেস কার্পেটিং হওয়ার শর্ত থাকলেও কাজ হচ্ছে ঠিকাদারের ইচ্ছামত। ৮ টন রোলারের স্থলে ব্যবহার হচ্ছে অনেক কম ৪-৫ টন ওজনের পৌরসভার নিজস্ব রোলার। ৯ হাজার লিটার ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন পানির গাড়ির স্থলে পাইপ দিয়ে রাস্তা ভেজানোর কাজ চলছে। কার্পেটিংয়ে ৬ হাজার লিটার বিটুমিন ধারন ক্ষমতা সম্পন্ন গাড়ি এবং পাথর-বিটুমিন (পিচ) মিক্সিং মেসিন ডেলিভারী প্রতি ঘন্টায় ৪৫ মেট্রিক টন থাকলেও প্রকল্পের আশে-পাশে দেখা যায়নি এসব সামগ্রী। ইজিপি’র শর্ত মোতাবেক ২৩ ইঞ্চি বেড কাটার কথা থাকলেও কাটা হয়েছে বেশ কম এবং রোলার ছাড়া বালুর ওপর মাটিযুক্ত পুরাতন ইটের খোয়া ও পরে কম পোড়া নরম ইটের খোয়া দেওয়া হয়েছে বলে জানান ওই রাস্তার পাশের কয়েকজন কাঠের দোকানী। লক্ষীপাশা চৌরাস্তা হইতে থানা গেইট পর্যন্ত রাস্তার পাশে ৩ ফুট সম্প্রসারণ কাজে একই প্রকার ইট বালু এবং মুল রাস্তায় ৪ ইঞ্চির স্থলে কম এবং এক নম্বর ইটের পিকেটের পরিবর্তে ইটের ব্যবহার করলেও বর্ধিত অংশে ৩ফুট প্রসস্থ রোলার ব্যবহার করেন নাই বলে জানান পাশের সেলুন ও ইলেট্রিক দোকানদার। সম্প্রসারণকৃত ৩ ফুট এবং লম্বায় ১৪৫ ফুট রাস্তায় কাদাঁ-মাটিযুক্ত প্রায় শতবর্ষী অপর রাস্তার স্যালভেজ ব্যবহার এবং পরিমানমতো পানি ও রোলার ব্যবহার না করায় কিছুদিন পর মাটি বসে রাস্তাটি বিনষ্ট হয়ে মানুষ ও যানবাহন চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়বে বলে জানান স্থানীয়রা। এ কাজের জন্য বিগত ২০২৪ সালের ২৫ নভেম্বর ১০২৮৫৬৩ নম্বর দরপত্র আহব্বান করা হয়। সেখানে ৩ লাখ ৩৫ হাজার ৭২৪ টাকা স্যালভেজ ধরা হয়। দেশের পটপরিবর্তন জটিলতায় ফের চলতি বছরের ২৪ জুন ১০৯৩৬৯৩ নম্বর দরপত্র (রি-টেন্ডার) আহব্বান করা হলে সেখানে রাস্তার পুরাতন ইটের খোয়া ও বালু (স্যালভেজ) বাদ দেওয়া হলেও উভয় রাস্তায় স্যালভেজ ব্যবহার করতে দেখা যায়। নাম না বলার শর্তে পৌরসভার একজন তালিকাভূক্ত ঠিকাদার বলেন, এসব কাজ নেওয়ার ক্ষেত্রে সর্বচ্ছ ৩১ শতাংশ টাকা ছাড় (লেস) দিয়ে দরপত্র এবং বিল উত্তোলনের আগে-পরে পৌর কর্তৃপক্ষকে ১৫ শতাংশ টাকা উৎকোচ দেওয়ার কারণে কাজের মান অর্ধেকে নেমে আসে, ফলে প্রকল্পগুলিতে নিম্মমানের সামগ্রী ব্যবহার হওয়ায় স্বল্প সময়ের মধ্যেই তার স্থায়ীত্ব হারিয়ে জন-দুর্ভোগ সৃষ্টি করে। ১০ শতাংশ টাকা প্রশাসক এবং ৫ শতাংশ টাকা প্রকৌশলী, পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা (সচিব) ও হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা তাদের হিস্যা অনুযায়ী নিয়ে থাকেন। এই ১৫ শতাংশ টাকার লেন-দেন এবং ঠিকাদারের বিল ছাড়করণের কাজটি পৌরসভার উপ-সহকারী প্রকৌশলী রতন কুমার রায় করে থাকেন বলেও জানান তিনি। তিনি আরও জানান, এই ৩ কোটি ৪৭ লাখ ৫২ হাজার ৯০০ টাকা এডিপি ও কোভিট-১৯ আওতার ১৫টি প্রকল্প। বিগত এক বছরে বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ের প্রকল্পের এবং পৌরসভার অনুকুলে প্রদেয় জন সাধারনের ট্যাক্সের টাকার প্রায় সবই পৌরসভার শীর্ষ ৫ কর্মকর্তা নয়-ছয় করে ভূয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে আত্মসাত করে আসছেন। আত্মসাতকৃত অর্থ উদ্ধারে নিরোপেক্ষ ও স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করে জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করণে কর্তৃপক্ষের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তিনি। অনুসন্ধানে আরও দেখা যায়, পৌরসভার অনুকুলে তালিকাভূক্ত ৫২ জন ঠিকাদার থাকলেও অধিকাংশ প্রকল্প বিশেষ কৌশলে মেসার্স ফকির এন্টার প্রাইজের নামে চুড়ান্ত হওয়ায় ব্যাপক কৌতুহলের জন্ম দিয়েছে স্থানীয়দের মাঝে। মেসার্স ফকির এন্টার প্রাইজের এসব কাজ করছেন উপজেলা বিএনপি’র শীর্ষ নেতারা। দরপত্রের টিডিএস মোতাবেক কাজ না হওয়া এবং প্রকল্পে নিম্মমানের সামগ্রী ও স্যালভেজ ব্যবহার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার মেসার্স ফকির এন্টার প্রাইজের স্বত্ত্বাধীকারী মো: জাহিদুল ইসলাম ভিটো বলেন, তার লাইসেন্সে মূলত: ভিন্ন ভিন্ন লোক কাজ করছেন, অনিয়মের বিষয়টি তিনি জানেন না। কাজে অনিয়ম হলে পূন:মূল্যায়ন করবেন তিনি।
পৌরসভার উপ-সহকারী প্রকৌশলী রতন কুমার রায়, প্রকল্প হতে ঠিকাদারের কাছ থেকে উৎকোচ গ্রহনের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, এধরনের টাকা নেওয়ার কোন সুযোগ নেই।
লোহাগড়া পৌরসভার প্রকৌশলী প্রণব মল্লিক বলেন, রি-টেন্ডারে ভূল বসত স্যালভেজ বাদ পড়লেও বিএকিউতে সংযোজন করা হয়েছে। কাজের মান, দরপত্রের টিডিএস এবং তদারকির ক্ষেত্রে কিছুটা সীমাবদ্ধতা ও পটপরিবর্তনের ফলে তিনি অনেকটা অসহায়াত্ব প্রকাশ করেছেন।
লোহাগড়া পৌরসভায় সাড়ে তিন কোটি টাকার প্রকল্পে সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতি

Be the first to comment on "লোহাগড়া পৌরসভায় সাড়ে তিন কোটি টাকার প্রকল্পে সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতি"