রাশেদ জামান, লোহাগড়া (নড়াইল) প্রতিনিধি ॥ তিনি সরকারী দলের একজন প্রভাবশালী নেতা। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে হয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি। কাউকে ভয় পান না, পাননি কোন দিনও। থানা ঘেরাও, অস্ত্র উঁচিয়ে বিরোধী পক্ষের মিছিল-সমাবেশ পন্ড করার যোগ্যতা রয়েছে তার! রাজনীতির পট পরিবর্তনেও তার কিছু যায় আসেনা। কারন তিনি সবসময় থাকেন সরকারে! তিনি এতটাই ভয়ংকর যে তার ভয়ে নিজ উপজেলার মানুষ মুখ খুলতে চাননা; এমনকি নিজ দলের নেতা-কর্মীও। মহা দাপটধারী যার একের পর এক দল পরিবর্তনকারী এই নেতার নাম মতিয়ার রহমান। নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান তিনি । স্থানীয় এক সাংবাদিককে হত্যা মামলার মতো একটি স্পর্শকাতর মামলায় জড়িয়ে এখন তিনি বেশ আলোচিত-সমালোচিত। আর তার কাছে সাংবাদিক শাহজাহান সাজুর ‘অপরাধ’ মহাদূর্নীতিবাজ এই চেয়ারম্যানের অপকর্মের খতিয়ান তুলে ধরেছেন খবরের কাগজে।
মতিয়ার রহমানের রাজনৈতিক ইতিহাস লোহাগড়াবাসীর অজানা নয়। ক্ষমতার পূজারী এই ব্যাক্তি কখনো ক্ষমতার বাইরে থাকেননি। যে দল যখন ক্ষমতায় এসেছে সেই দলে ঢুকে পড়েছেন। শুরুটা জাতীয়পার্টির রাজনীতি দিয়ে। এরপর বিএনপি হয়ে বর্তমানে ক্ষমতাশীন আওয়ামীলীগের উপজেলা কমিটির সহসভাপতি হয়েছেন।
স্থানীয় একাধিক রাজনৈতিক নেতা ও সামাজিক ব্যাক্তিদের কাছ থেকে জানাগেছে,আশির দশকের শেষের দিকে জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন মতিয়ার। ১৯৯০ সালে এরশাদের পতন হলে বছর খানেক গা-ডাকা দেন তিনি। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠন করলে ফের রাজনীতিতে আর্বিভাব ঘটে তার। এসময় কাশিপুর ইউনিয়নের ঈশানগাতী গ্রামের দু’জনের সহযোগিতায় তৎকালীন জেলা বিএনপির সভাপতি ও নড়াইল-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল কাদের শিকদারের কাছে গিয়ে বিএনপিতে যোগদান করেন। বিএনপিতে যোগ দিয়েই শুরু করেন সন্ত্রাসী কর্মকান্ড। তার অত্যাচার-নির্যাতনে অতিষ্ট হয়ে পড়েন এলাকার সাধারন মানুষ। ১৯৯৬ সালে বিএনপি ক্ষমতা হারালে ফের গা-ডাকা দেন সুবিধাবাদী মতিয়ার রহমান। ১৯৯৬ সালের জুনে আওয়ামীলীগ সরকারে আসলে স্থানীয় কয়েকজন আওয়ামীলীগ নেতার মাধ্যমে সাবেক সংসদ সদস্য প্রায়াত শরীফ খসরুজ্জামানের কাছে গিয়ে আওয়ামীলীগে যোগদান করেন।
২০১৪ সালে আওয়ামীলীগ তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করলে নড়াইল-২ আসনের এমপি নির্বাচিত হন শরিকদল বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির শেখ হাফিজুর রহমান। ধুরন্ধর মতিয়ার তিনার সাথেও গড়েছিলেন নীবিড় সক্ষতা। বাগিয়ে নিয়েছিলেন বেশ কয়েকটি প্রকল্প।
জানতে চাইলে লোহাগড়া উপজেলা জাতীয়পার্টির প্রবীণ নেতা সৈয়দ মফিজুর রহমান বলেন,‘ আশির দশকে প্রথম উপজেলা নির্বাচনের মুখে জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয় মতিয়ার। এ সময় জাতীয় পার্টির সভা-সমাবেশে অংশ নিতে দেখা গেছে তাকে’।
নড়াইল জেলা বিএনপির একজন সিনিয়র সহসভাপতি নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই প্রতিবেদককে বলেন, লোহাগড়ার কাশিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান এক সময় বিএনপির রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৯১ সালে তৎকালীন জেলা বিএনপির প্রভাবশালী নেতা আব্দুল কাদের শিকদারের হাতে হাত রেখে বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত হন তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে জেলা বিএনপির ওই সিনিয়র নেতা বলেন,‘মতিয়ার চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে দূর্নীতির খবর লেখায় সাংবাদিক সাজুকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে খুনের মামলায় জড়ানো হয়েছে’।
এদিকে মতিয়ার রহমানের নব্বই দশকের এক সহপাঠী জানান, তিনি ছাত্র জীবনে ছাত্রদলের রাজনীতির সাথে সংম্পৃক্ত ছিলেন। লোহাগড়া কলেজে পড়াকালীন তিনি ( মতিয়ার ) ছাত্রদলের মিছিল-মিটিং-এ নিয়মিত অংশ নিতেন।
অপরদিকে লোহাগড়া উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা জানান, বিএনপি আমলে মতিয়ার রহমান ছিল হিংস্র প্রকৃতির। আওয়ামীলীগের মিছিল-মিটিং বানচান করতেও সক্রিয় ছিলেন তিনি। ১৯৯৫ সালে তৎকালীন বিএনপির শাসনামলে সরকার বিরোধী আন্দোলনে কাশিপুর এড়েন্দা বাজারে স্থানীয় আওয়ামীলীগ মিছিল করতে চাইলে মতিয়ার বাধা হয়ে দাঁড়াতেন। দলবল নিয়ে অস্ত্র উঁচিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দিতেন আওয়ামীলীগের মিছিল-সমাবেশ। এতো কিছুর পরও এক বছরের মাথায় সরকার পরিবর্তন হলে সরকারি দলের নেতাদের ম্যানেজ করে ফের নতুন দলে সরকারের সাথেই থেকেছেন ডিগবাজিতে ওস্তাদ মতিয়ার।
লোহাগড়া উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি মুন্সী আলাউদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মসিয়ূর রহমান বলেন,‘ ঈর্ষান্বিত হয়ে সাংবাদিক সাজুকে হত্যার মতো একটি স্পর্শকাতর মামলায় জড়ানো হয়েছে। ঘটনার সময় সাজু সেখানে উপস্থিত ছিলেন না বলে জেনেছি। এ ব্যাপারে জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে অবহিত করেছি। জানিয়েছি নিন্দাও। বিষয়টি জেলা আইনশৃংখলা কমিটির সভায়ও আলোচনা হয়েছে। সাংবাদিকের নামে মিথ্যা মামলা দেয়ায় নিন্দা জানিয়েছেন জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।
এ সময় আলোচিত এ হত্যাকান্ডে যারা জড়িত-তাদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানান উপজেলা আওয়ামীলীগের এই দুই নেতা।
Be the first to comment on "দলের ডিগবাজিতে ওস্তাদ, পরিবর্তন হয় না মতিয়ারের ‘সরকার’!"