নিউজ ডেস্ক॥
তারা সকলেই একই পরিবারের সদস্য। কারও বয়স ১১, কারওবা ৫০। তবে সবার পরিচয় একটাই তারা লাঠিয়াল। দেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে দলে বলে লাঠির কসরত দেখানোই তাদের পেশা। এ পেশা তারা বয়ে এনেছেন চার প্রজন্ম ধরে। একসময় ব্যক্তি পরিচয়েই চলত দলটি। বছর দশেক আগে দলটির নামকরণ করা হয় নড়াইলের কৃতী সন্তান বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদের নামে। দলটির নাম এখন ‘বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ লাঠিখেলা ও সাংস্কৃতিক ক্লাব’।
লাঠি খেলার দলে লাঠি হাতে দাঁড়ানো সর্বকনিষ্ঠ সদস্যের নাম মেহনাজ খাতুন। তিন বছর ধরে লাঠিখেলায় নিয়মিত অংশ নেয় সে। এই খুদে খেলোয়াড়ের নাকি সাত বছর বয়সে লাঠিখেলার হাতেখড়ি। এখন পড়ছে চতুর্থ শ্রেণিতে। সে জানায়, পড়াশোনা আর লাঠিখেলা সমানতালেই চালিয়ে যাচ্ছে সে। এতে তার কোন অসুবিধা নেই।
মেহনাজের সঙ্গে আলাপের মধ্যেই কথা বলতে উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে আসেন বাচ্চু মিয়া। তিনি দলটির পরিচালক। আলাপ কালে তিনি জানান ‘ও (মেহনাজ) আমার ভাতিজি। ওর মতো আমাদের দলের সব ছেলে মেয়েই পড়াশোনা করে। এরা সবাই আমার ভাইবোনের ছেলেমেয়ে।’
বাচ্চু মিয়ার বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে। লাঠিখেলার সঙ্গে তার সম্পর্ক ৪০ বছরের। ১০/১১ বছর বয়সে লাঠিখেলার তালিম নিয়েছিলেন বড় ভাই লুৎফর রহমানের কাছে। তার বাবা আবদুল কাদের মোল্লাও ছিলেন একজন লাঠিয়াল। তাই ছোটবেলা থেকেই বাড়ির উঠানে নিয়মিত লাঠিখেলার আসর বসতে দেখতেন।
বাচ্চু মিয়া জানালেন, তার দাদাও এই লাঠিখেলার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাদের উঠানে রোকন শেখ নামের একজন পেশাদার প্রশিক্ষক নিয়মিত আসতেন। পারিশ্রমিকের বিনিময়ে পরিবারের শিশুদের লাঠিখেলা শেখাতেন তিনি। বাচ্চুর মিয়ার বড় ভাই লুৎফর রহমান সেই প্রশিক্ষক রোকন শেখের কাছ থেকেই মূলত লাঠিখেলা শিখেছেন।
বাচ্চু মিয়া যখন ছোট ছিলেন, তখন নড়াইল ও এর আশপাশের এলাকায় লাঠিখেলা বেশ জনপ্রিয় ছিল। যে কোনো উৎসব আয়োজনে লাঠিয়ালদের ডাক পড়ত। অন্ততঃ ছয়টি নিয়মিত লাঠিয়াল দল ছিল তখন ওই অঞ্চলে। বর্তমানে তাদের দলটিই নিয়মিত লাঠিখেলা দেখায় বলে জানালেন তিনি।
তার মতো দলের সদস্যদের অন্য পেশাও আছে। যেমন বাচ্চু মিয়া পেশায় কাঠমিস্ত্রি। নড়াইলের সদর উপজেলার ভদ্রবিলা ইউনিয়নে তার দোকান। যতই কাজের চাপ থাকুক না কেন, বিকেলে দোকান থেকে ছুটে আসেন বাড়ির উঠানে। ভাইবোনের ছেলেমেয়েদের লাঠি খেলার প্রশিক্ষণ দেন নিয়মিত। তার সঙ্গে প্রশিক্ষক আছেন আরও দুজন। একজন তাঁর চাচাতো ভাই হাবিবুর রহমান, আরেকজন প্রতিবেশী সায়েম শেখ।
ডাক পেলে দলটি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন বাচ্চু মিয়া। বর্তমানে নিয়মিত খেলোয়াড়ের সংখ্যা ৩০ জন। এর মধ্যে ১২ জন মেয়ে। এক সময় দলে শুধু পুরুষ সদস্যই ছিল। ১১ বছর থেকে দলে নারী সদস্য যুক্ত করা হয়েছে। বাচ্চু মিয়া বলছিলেন, ‘দলে নারী সদস্য যুক্ত করার ব্যাপারে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন নৃত্যশিল্পী লুবনা মারিয়াম। এরপর থেকেই ভাগনি-ভাতিজিদের লাঠিখেলা শিখিয়েছি।’
তবে কিছুটা হতাশাও আছে দলের সদস্যদের মধ্যে। হতাশার সুরে কথাগুলো বলছিলেন বাচ্চু মিয়ার ভাগনে ও সংগঠনটির সভাপতি আনিচুর রহমান, ‘ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলার কদর এখন নেই বললেই চলে। সে ভাবে আর তাদের ডাকও পড়ে না। যাতায়াত আর থাকা-খাওয়া বাবদই চলে যায় বেশির ভাগ টাকা।’
তিনি জানান, আর্থিক অনটনের মধ্যেও লাঠিখেলার প্রসারের জন্য বিভিন্ন ধরনের চেষ্টা করে যাচ্ছেন তারা। গত বছরের মার্চ মাসে তাদের নিজ ইউনিয়নে আয়োজন করেছিলেন লাঠিখেলা উৎসবের। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লাঠিয়াল দলগুলো এ উৎসবে অংশ নিয়েছিল। এখন থেকে প্রতিবছরই এ উৎসব আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
বাংলাদেশের সাংস্কৃতির অন্যতম অনুসঙ্গ হলো, লাঠিখেলা । হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের জীবন্ত স্বারক এই লাঠিখেলা। লাঠিখেলা এবং লাঠিয়াল পরিবারের সদস্যদের পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র এগিয়ে আসবেন-এমন প্রত্যাশা জেলাবাসীর।
Be the first to comment on "নড়াইলের লাঠিয়াল পরিবারের সাফল্য গাঁথা"