শিরোনাম

 বিদায় কর্মবীর

বিদায় কর্মবীর

নিউজ ডেস্ক॥ কনকনে শীত উপেক্ষা করে আর্মি স্টেডিয়ামের সবুজ প্রান্তরে জড়ো হয়েছিল অগণিত মানুষ। সবার চোখে মুখে প্রিয়জন হারানোর শোক। হাজার হাজার মানুষ শোক আর শ্রদ্ধায় শেষ বিদায় জানিয়েছেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক-এর প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদকে। আজীবন মানুষের জীবন মান উন্নয়নে কাজ করা এই কর্মবীর শেষ বিদায়ে পেয়েছেন দেশের অগণিত মানুষের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা। আর্মি স্টেডিয়ামে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে দুপুরের পর বনানী কবরস্থানে স্ত্রীর কবরে চির নিদ্রায় শায়িত হন বেসরকারি উন্নয়নের এই স্বপ্নদ্রষ্টা।

আর্মি স্টেডিয়ামে আনার আগে সকালে কিছু সময়ের জন্য ফজলে হাসান আবেদের কফিন নেয়া হয় মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে। সেখানে ব্র্যাকের কর্মীরা এসেছিলেন তাদের প্রিয় ‘আবেদ ভাইকে’ শেষবার দেখতে। শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রোববার সারাদেশে সব অফিস বন্ধ রেখেছে ব্র্যাক।
সকালে স্যার ফজলে হাসান আবেদের কফিন আর্মি স্টেডিয়ামে নিয়ে আসা হলে প্রথমেই প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদের পক্ষে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে শ্রদ্ধা জানানো হয়। পরে জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা ফুলেল শ্রদ্ধা জানান ফজলে হাসান আবেদের কফিনে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নিজ নিজ দলের পক্ষে ফজলে হাসান আবেদের কফিনে শ্রদ্ধা জানান। এছাড়া আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, সালমান এফ রহমান, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো.আতিকুল ইসলাম, জাতীয় পার্টির নেতা আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, সাবেক মন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস, জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলি খান, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ইনাম আহমদ চৌধুরী, বিএনপি নেতা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ম. তামিম শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এছাড়া জাতিসংঘের ঢাকা কার্যালয়, ইউএসএইড, বিকাশ, কারিতাস, বাংলা একাডেমি, বেঙ্গল ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়।

শ্রদ্ধা নিবেদন করতে এসেছিলেন ঢাকায় বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশনের প্রতিনিধিরা।
সকাল ১০টা ২৫ মিনিটে সাদা ফুলে সজ্জিত কফিনবাহী এম্বুলেন্সটি আর্মি স্টেডিয়ামে নেয়া হয়। স্যার ফজলে হাসান আবেদকে শ্রদ্ধা জানাতে জনতার ঢল নামে সেখানে। সারিবদ্ধভাবে একাধিক লাইনে দাঁড়িয়ে তাকে শেষ বারের মতো শ্রদ্ধা জানান অগণিত মানুষ।
এসময় আর্মি স্টেডিয়ামে ফজলে হাসান আবেদের জন্য রাখা শোক বইয়েও অনেকে মরহুমের জীবন ও কর্ম স্মরণ করে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মন্তব্য লিখেন। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে দুপুর পৌনে ১টায় স্টেডিয়ামেই স্যার আবেদের নামাজে জানাজা সম্পন্ন হয়। জানাজার শুরুর আগে স্যার ফজলে হাসান আবেদের ছেলে শামেরান আবেদ বলেন, ‘সবাই আমার বাবাকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন ও অকৃত্রিম ভালোবেসেছেন। এজন্য আমি সবার কাছে কৃতজ্ঞ। বাবা সারাজীবন সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করেছেন, সবার কথা চিন্তা করেছেন।’ তিনি এসময় তার পিতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের জন্য সবার কাছে দোয়া চান। পরে নামাযে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ইমামতি করেন হাফেজ মাওলানা আহসান উল্লাহ। জানাজার পর স্যার আবেদের লাশবাহী এম্বুলেন্সটি বনানী কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। বনানী কবরস্থানে স্ত্রী আয়েশা হাসানের কবরে সমাহিত করে মোনাজাত করা হয়।

স্যার ফজলে হাসান আবেদ ১৯৩৬ সালের ২৭শে এপ্রিল হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচয়ের কামালখানী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পাবনা জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর তিনি ব্রিটেনের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে নেভাল আর্কিটেকচারে ভর্তি হন। পরে সেটা বাদ দিয়ে তিনি লন্ডনের চার্টার্ড ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টসে ভর্তি হন। ১৯৬২ সালে আবেদ তার প্রফেশনাল কোর্স সম্পন্ন করেন। ৭০ এর ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী পূর্ণবাসন কার্যক্রমে সক্রিয় অংশ নেন আবেদ। সেখান থেকেই মানুষের জীবন মান উন্নয়নের দর্শন পান। ৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ব্র্যাক। নিরলসভাবে এই প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিয়ে ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাককে পরিণত করেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায়। চলতি বছরই সংস্থাটির চেয়ারম্যানের পদ থেকে অবসর নেন তিনি। জনকল্যাণ, দারিদ্র বিমোচন ও সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখার স্বীকৃতি হিসেবে স্যার ফজলে হাসান আবেদ বাংলাদেশ ও বিশ্বের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অ্যাওয়ার্ড এবং সম্মাননা লাভ করেন। গত শুক্রবার রাত ৮টা ২৮ মিনিটে ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর।

Print Friendly, PDF & Email
basic-bank

Be the first to comment on " বিদায় কর্মবীর"

Leave a comment

Your email address will not be published.


*