লোহাগড়ায় ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী ইউপি চেয়াম্যানের বিরুদ্ধে থানা ঘেরাও,পুলিশকে মারপিট,অস্ত্র লুট,ব্যাংক ও বাস ডাকাতির অভিযোগে মামলা

রাশেদ জামান, লোহাগড়া (নড়াইল) প্রতিনিধি ॥ নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান একজন মহাদুর্নীতিবাজই নন, ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীও। ব্যাংক আর বাস ডাকাতির অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলার কথাও শোনা যায়। বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে লোহাগড়া থানা ঘেরাও করে পুলিশ সদস্যদের মারপিট ও অস্ত্র লুটের ঘটনায় অভিযুক্ত এই চেয়ারম্যান। তার রয়েছে একটা টর্চারসেলও। যেখানে তার ছোটভাই সাবেক এক শিবির নেতার নেতৃত্বে চলে বিরুদ্ধবাদীদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন আর মাদকের রমরমা ব্যবসা। একের পর এক সন্ত্রাসী কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান এলাকায় এক মূর্তিমান আতঙ্ক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। যে কারনে ভয়ে তার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতে সাহস পান না। এমনকি গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভয়ে কেউ তার বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করারও সাহস দেখায়নি।
গত কয়েকদিন ধরে লোহাগড়া ও আশপাশের এলাকায় মানুষের মুখে মুখে এভাবেই ঘুরছে চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমানের দুর্নীতি, সন্ত্রাস আর লুটপাটের নানা কাহিনী। দৈনিক মানবজমিন ও গ্রামের কাগজের লোহাগড়া প্রতিনিধি ও লোহাগড়া প্রেসক্লাবের যুগ্ন সাধারন সম্পাদক শাহজাহান সাজুর বিরুদ্ধে খুনের সাজানো মামলার নেপথ্য নায়ক এই চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান। তার অপকর্মের প্রতিটি বিষয়েই সকল ভয়-ভীতিকে উপেক্ষা করে সংবাদ প্রকাশ করেছেন শাহজাহান সাজু। সে কারনে ইতোপূর্বে তাকে হত্যারও হুমকি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতেও পিছপা না হয়ে সত্য প্রকাশে অবিচল থাকা এই কলম সৈনিককে দেখে নেবার অপচেষ্টার অংশ হিসেবে কাশিপুর ইউনিয়নের গন্ডব গ্রামে সংঘটিত হত্যাকান্ড মামলায় আসামি করতে তিনি প্ররোচিত করেছেন মামলার বাদীকে। বিষয়টি নিয়ে যখন সকল মহলে ক্ষোভ, নিন্দা আর প্রতিবাদের ঝড় বয়ে চলছে তখন এর নেপথ্যের কারন অনুসন্ধানে নামে গণমাধ্যমকর্মীরা। অনুসন্ধানে চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমানের ভয়ঙ্কর অপরাধ আর দুর্নীতির খবর বেরিয়ে আসে। এলাকাবাসী এই প্রতিবেদকের সাথে কথা বলার সময় তাদের নাম ও পরিচয় গোপন রাখার শর্তে দিয়েছেন নানা তথ্য। সকলের একটাই দাবি, এই দানবের (মতিয়ার চেয়ারম্যান) বিচার হয়ে কাশিপুর ইউনিয়ন বাসি পাপমুক্ত হোক’। কাশিপুর ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বর আব্দুল অহেদ শেখ জানান, চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান বিগত ২০১৬ সালের ৩রা আগস্ট ক্যাডার বাহিনী নিয়ে লোহাগড়া থানা ঘেরাও করে পুলিশকে মারপিট ও অস্ত্র লুট করেন। ওই ঘটনায় অফিসারসহ পাঁচজন পুলিশ আহত হন। পুলিশ বাদী হয়ে ওই রাতেই মতিয়ার রহমানকে প্রধান আসামি করে ২১ জনের নামে লোহাগড়া থানায় মামলা দায়ের করে এবং মতিয়ারকে রাতেই গ্রেফতার করে জেলহাজতে প্রেরন করে। ২০১৭ সালের ১৬ জুলাই ওই মামলায় পুলিশ মতিয়ার রহমানসহ ২০ জনের নামে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশীট) জমা দেয়।
এলাকাবাসীর অভিযোগ থেকে জানা যায়, ২০১৬ সালের ৩ আগস্ট গভীর রাতে লোহাগড়া পৌরসভার কচুবাড়িয়া গ্রামের অধিবাসী ও পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সভাপতি বিবেকানন্দ দাসের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেন মতিয়ার রহমানসহ তার সন্ত্রাসী বাহিনী। ওই ঘটনায় বিবেকানন্দ দাস বাদী হয়ে চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমানকে প্রধান আসামি করে ৩ আগস্ট রাতে লোহাগড়া থানায় ৩২ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত অন্তত দু’শ’জনের নামে মামলা দায়ের করেন।
অভিযোগে জানা যায়, ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে ঠিকাদারী কাজ না করেই অর্থ ছাড়ে ব্যর্থ হয়ে উপজেলা (এলজিইডি) প্রকৌশলী ওসমান গণীকে তার অফিস কক্ষে বেধড়ক মারপিট করেন মতিয়ার রহমান। এ ঘটনায় ওসমান গণী বাদী হয়ে মতিয়ারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করেন। পরে অবশ্য তৎকালিন উপজেলা চেয়ারম্যান ফয়জুল আমীর লিটু ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের মধ্যস্থতায় মুচলেকা দিয়ে তিনি ঘটনাটি মিমাংসা করে নিতে সক্ষম হন।
২০১৭ সালের ১৭ নভেম্বর ঈশানগাতি গ্রামের মজিবর রহমানের স্ত্রী ফাতেমা বেগম তুলার আদালতে দায়ের করা ১৪৪ ধারা (যার নং এমপি ২৬৫/১৭) অমান্য করে জোরপূর্বক বাড়িতে প্রবেশ করে তার মূল্যবান গাছ কেটে বিক্রি করেন চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান।
কাশিপুর এলাকায় রয়েছে চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমানের একক রামরাজত্ব। তার ভয়ে তটস্থ হয়ে পড়েছেন এলাকার লোকজন। বিগত ২০১৬ সালের পঞ্চম ধাপে কাশিপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে তার ভয়ে কোন প্রার্থী মনোনয়নপত্র সংগ্রহ না করায় তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার কারনে এলাকার সাধারন মানুষকে তিনি মানুষ বলে মনে করেন না। ফলে সরকারি, বেসরকারি সকল উন্নয়ন কাজে তার বিরুদ্ধে পুকুর চুরির অভিযোগ থাকলেও ভয়ে প্রশাসনসহ কেউ মুখ খোলেন না।
এলাকাবাসীর অভিযোগ থেকে আরও জানা যায়, চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমানের ভাই এড়েন্দা বাজারের চাতাল মালিক মুজিবুর রহমান ছাত্র জীবনে খুলনা বিএল কলেজে ছাত্র শিবিরের নেতা ছিলেন। ওই চাতালে চেয়ারম্যানের রয়েছে টর্চারসেল। সেখানে আগ্নেয়াস্ত্রসহ বিশাল ক্যাডার বাহিনী সবসময় অবস্থান করে। ভায়ের পক্ষে যা দেখাশোনা করেন সাবেক এই শিবির নেতা মুজিবুর রহমান। চেয়ারম্যানের অপকর্মে কেউ বাধা দিলে বা প্রতিবাদ করলে ওই ক্যাডার বাহিনী দিয়ে টর্চারসেলে নিয়ে তাকে শায়েস্তা করা হয়। টর্চারসেলে রয়েছে মাদকের রমরমা ব্যবসাও। দেশের সর্বচ্চ গোয়েন্দা নজরদারির ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ১৫এপ্রিল ১৮ খ্রি: ০৩.১২.০০০০.০৭৯.০১৬.২৪.২০১৭.-৩৬৯ (৩) নং স্বারক) তালিকাভূক্ত মাদক ব্যবসায়ী চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান।
১৯৯৩ সালের অক্টোবর মাসে যশোর-লক্ষীপাশা সড়কের বসুপটি নামক স্থানে গণপরিবহনে (বাস) ডাকাতি ও ১৯৯৪ সালে এড়েন্দা বাজারে অবস্থিত অগ্রণী ব্যাংক ডাকাতি মামলার অন্যতম প্রধান আসামিও ছিলেন চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান। এঘটনার পরই ব্যাংক কর্তৃপক্ষ শাখাটি লোহাগড়া বাজারের মোল্যা মার্কেটে স্থানান্তর করেন। ডাকাতিকালে ব্যাংকের নিরাপত্তাকর্মীর খোয়া যাওয়া আগ্নেয়াস্ত্রটি আজও উদ্ধার হয়নি। উপজেলার ধলইতলা গ্রামের ওই নিরাপত্তাকর্মী অস্ত্র ও চাকরি হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
স্থানীয় মুরব্বিদের কাছ থেকে জানা যায়, পিতা আয়েন উদ্দিনের মতই জুলুমবাজ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান। তার পিতা আয়েন উদ্দিনের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে কচুবাড়িয়া গ্রামের সংখালঘু নিরোদ দত্ত তার পিতা আয়েনউদ্দিনকে গলা কেটে ও কুপিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় নিরোদ দত্ত প্রধান আসামি ছিলেন। মামলা চলাকালিন নিরোদ দত্ত ভাড়াটিয়া খুনির হাতে নিহত হন। নিরোদ দত্তের খুনের ঘটনায় মতিয়ারের বড় ভাই লুৎফর রহমান প্রধান আসামি ছিলেন। লোহাগড়া পল্লী বিদ্যুতের আঞ্চলিক পরিচালক মিরাজ ফকিরকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে তার চার হাত-পা বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করলেও এক পা বিচ্ছিন্ন করতে সক্ষম হন মতিয়ার রহমানসহ তার সন্ত্রাসী বাহিনী। মিরাজ ফকির কৃত্রিম পায়ের ওপর ভর করে অমানবিক দিনযাপন করছেন। এ ঘটনায় মতিয়ারের নামে মামলা করেও বিপাকে পড়েন মিরাজ ফকির। মামলা তুলে নিতে মিরাজ ফকিরের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে প্রাণনাশের হুমকি দেয় চেয়ারম্যান মতিয়ারসহ তার ক্যাডার বাহিনী। মিরাজ ফকির পা হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করলেও প্রাণে বেঁচে থাকার আশায় মামলা তুলে নিতে বাধ্য হয়। এলাকায় কথিত রয়েছে চেয়ারম্যানের দেহরক্ষি লোহাগড়া পৌর এলাকার কচুবাড়িয়া গ্রামের লাখির শেখের ছেলে তুহিন শেখ ও কাশিপুর গ্রামের মান্নান খার ছেলে মেহেদীর কাছে দু’টি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র (পিস্তল) রয়েছে। যা নিয়ে চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান বিভিন্ন জায়গায় গমনাগমন করে থাকেন। # চলবে #

Print Friendly, PDF & Email
basic-bank

Be the first to comment on "লোহাগড়ায় ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী ইউপি চেয়াম্যানের বিরুদ্ধে থানা ঘেরাও,পুলিশকে মারপিট,অস্ত্র লুট,ব্যাংক ও বাস ডাকাতির অভিযোগে মামলা"

Leave a comment

Your email address will not be published.


*