নিউজ ডেস্ক: কুড়িগ্রামে সরকারিভাবে বরাদ্দকৃত অ্যাম্বুলেন্সের অধিকাংশই যান্ত্রিক ত্রুটি, অবহেলা ও বরাদ্দ না থাকার অজুহাতে বিকল হয়ে পড়ে আছে। এই সুযোগে জেলাজুড়ে চলছে ফিটনেসবিহীন লক্কর-ঝক্কর মার্কা প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্সের রমরমা ব্যবসা।
রোগী পরিবহনের নূন্যতম সুযোগ সুবিধা না থাকলেও রোগীর স্বজনদের পকেট কেটে নেয়া হচ্ছে মোটা অংকের টাকা। বিষয়টি অবগত থাকলেও বিআরটিএর উপর দোষ চাপিয়ে নিজেদের আড়াল করছে খোদ স্বাস্থ্য বিভাগ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গুরুতর রোগীদের পরিবহনের জন্য স্বাস্থ্য বিভাগের ১৭টি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। এর মধ্যে ৯টি সচল। বাকী ৮টি অ্যাম্বুলেন্স নষ্ট হওয়ার পর মেরামতের ব্যবস্থা না করেই অচল অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে। এরপরও সচল অ্যাম্বুলেন্সগুলো সকাল বিকাল অচল হয়ে পড়ে বিশেষ কারণে।
সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের স্বল্পতার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন ক্লিনিক ও ব্যক্তি অ্যাম্বুলেন্স না কিনে তারা মাইক্রেবাস বা পিকআপকে মডিফাই করে তৈরি করেছে ফিটনেসবিহীন প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্স। এই অ্যাম্বুলেন্স নামের গাড়িটিতে অক্সিজেন, ফ্যান বা রোগী পরিবেনের স্ট্রেচার কিংবা উপযুক্ত ব্যবস্থা ও শোবার সিট নেই। সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের সংকট থাকায় জীবন বাঁচানোর তাগিদে সমস্যা জর্জরিত এসব অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করছেন সেবা গ্রহীতারা।
অভিযোগ রয়েছে, ফিটনেসবিহীন এসব অ্যাম্বুলেন্সের মালিক বেসরকারি ক্লিনিক ছাড়াও সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের চালকসহ স্থানীয় পুলিশ সদস্যও রয়েছে। যার অধিকাংশের কাগজপত্র নেই। অ্যাম্বুলেন্স হওয়ার কারণে ট্রাফিকের নজরদারির মধ্যে আসে না এই গাড়িগুলো। ফলে দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করছে তারা।
এমনকি সরকারি হাসপাতাল চত্বরে পার্কিং নিষিদ্ধ থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। কিছু অসাধু কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজস করে হাসপাতাল চত্বরেও রাখা হচ্ছে এসব প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্স।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন চালক বলেন, এসব ফিটনেসবিহীন গাড়ির জন্য প্রতিমাসে ২০০ টাকা হারে চাঁদা দিতে হয় আইশৃঙ্খলা বাহিনীকে।
ট্রাফিক বিভাগের ইন্সপেক্টর আতাউর রহমান জানান, রোগী পরিবহনের বিষয়টি মাথায় রেখে সকল অ্যাম্বুলেন্সকে ছাড় দেয়া হয়। পরিবহনে চাঁদা উত্তোলনের অভিযোগ সঠিক নয়। এ ব্যাপারে অভিযোগ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, জেলায় বেসরকারিভাবে ২০টি ফিটনেসবিহীন অ্যাম্বুলেন্স চলাচল করছে। এর মধ্যে খান ক্লিনিকের ৩টি, পপুলার ক্লিনিকের ২টি, আইডিয়াল ক্লিনিকের ১টি, কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স চালক ফজলু ড্রাইভারের নামে ২টি, রাজারহাট হাসপাতালের ড্রাইভার আব্দুল কালামের নামে ২টি, সদর থানার এসআই আরমানের নামে ১টি, বিশ্বাস অ্যাম্বুলেন্স নামে সান্টু মিয়া ও আলেফ উদ্দিনের নামে ২টি, আকুল অ্যাম্বুলেন্স, ভুরুঙ্গামারীতে মাদার্স ক্লিনিক ও মাহবুব ক্লিনিকের নামে ২টি, নাগেশ্বরীতে ২টি এবং ফুলবাড়ী উপজেলায় রয়েছে ৩টি অ্যাম্বুলেন্স।
এসব অ্যাম্বুলেন্স রোগীদের কোনো প্রকার সেবার ব্যবস্থা না রেখেই পরিবহন করছে। নেই স্ট্রেচার কিংবা অক্সিজেন সিলিন্ডার। হাসপাতাল চত্বরে এসব অ্যাম্বুলেন্স পাকিং করায় যানজটের পাশাপাশি রোগীদের ভোগান্তি বেড়েছে।
সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা যায়, সরকারি অ্যাম্বুলেন্সে প্রতি কিলোমিটার যাতায়াত ভাড়া ১০ টাকা এবং পৌরসভার মধ্যে ২০০ টাকা। সেখানে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স কিলোমিটার প্রতি ভাড়া নিচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা। এভাবে প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্সের নামে ফিটনেসবিহীন গাড়ি নামিয়ে লাখ-লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে মালিক পক্ষ।
কুড়িগ্রাম জেলা অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার কল্যাণ সমিতির সভাপতি মমিনুল ইসলাম মনু এ সকল অভিযোগের কথা স্বীকার করে বলেন, জীবিকার প্রয়োজনে ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা মাসিক বেতনে আমরা এই কাজ করছি। অনেকের ড্রাইভিং লাইসেন্সও নেই। আবেদন করা হয়েছে।
সেবাগ্রহীতা আকরাম ও হামিদুল জানান, প্রায় প্রতিটি প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্সে অক্সিজেন, ফ্যান, রোগী পরিবহন সিট না থাকায় এবং শব্দজনিত কারণে পথে নানা ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে রোগীকে। এছাড়া এই অ্যাম্বুলেন্সগুলো লক্কর ঝক্কর মার্কা। সরকারি অ্যাম্বুলেন্স সংকট থাকায় জীবন বাঁচানোর তাগিদে ঝুঁকি নিয়ে প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করতে হচ্ছে।
এ ব্যাপারে জেলা ক্লিনিক মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আহসান শামিম জানান, সরকারি হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সগুলো প্রায় সময় নষ্ট থাকার কারণে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের চাহিদা বেড়েছে।
তবে তিনি স্বীকার করেন, সরকারি হাসপাতালের সামনে রাখা অ্যাম্বুলেন্সগুলোর অধিকাংশই লক্কর-ঝক্কর। নেই অক্সিজেন সাপোর্ট।
তিনি দাবি করেন, খান ক্লিনিকের নামে ৩টি অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও একটি’র মালিক তিনি। এ রকম ক্লিনিকের নাম ব্যবহার করা হলেও মালিক কিন্তু ক্লিনিকগুলো নয়। পরিবহন ব্যবসায়ীরা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে এসব করছেন।
কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালের তত্বাবধায়ক ডা. অজয় কুমার রায় সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের সল্পতার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্সগুলোর মান সন্তোষজনক নয়। এগুলোর সেবার মান বাড়াতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি বাড়ানো দরকার।
এ ব্যাপারে সিভিল সার্জন ডা. জয়নাল আবেদীন জিল্লুর জানান, সমস্যা জর্জরিত এসব অ্যাম্বুলেন্সগুলোর সেবার মান নিয়ে আমাদের মনেও সংশয় রয়েছে।চালকদের দক্ষতা, রোগীদের ভোগান্তি ও অ্যাম্বুলেন্সের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা হয়েছে। কিন্তু এসব দেখভালের বিষয় আমাদের নয়। এটি বিআরটিএ’র কাজ। আমরা কি করতে পারি?
সূত্র: জাগো নিউজ
Be the first to comment on "সরকারি অ্যাম্বুলেন্স বিকল : চলছে প্রাইভেটের রমরমা ব্যবসা"