শিরোনাম

স্করপেন জলে নামার আগেই বিপত্তির ছায়া

নিউজ ডেস্ক : জলে ডুব দেওয়ার আগেই ফাঁস হয়ে গেল সাড়ে তিনশো কোটি ডলার দামের ডুবোজাহাজের যাবতীয় জারিজুরি!

চিন, পাকিস্তানের সঙ্গে যুঝতে ছ’টি ফরাসি স্করপেন ডুবোজাহাজের বরাত দিয়েছে ভারতীয় নৌসেনা। ফরাসি নির্মাতা সংস্থা ডিসিএনএস-এর তত্ত্বাবধানে ওই ডুবোজাহাজগুলি তৈরি হচ্ছে মুম্বইয়ের মাজগাঁও ডকে। চলতি বছরের শেষেই প্রথম ডুবোজাহাজটির নৌসেনায় যোগ দেওয়ার কথা। কিন্তু তার আগেই এই ডুবোজাহাজের যাবতীয় রহস্য ফাঁস হয়ে গিয়েছে বলে জানিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার সংবাদপত্র ‘দ্য অস্ট্রেলিয়ান’। তাদের দাবি, ‘রেসট্রিকটেড স্করপেন ইন্ডিয়া’ নামের ২২,৪৩৯ পৃষ্ঠার গোপন নথি তারা দেখেছে। যাতে ওই ডুবোজাহাজের যুদ্ধ করার পদ্ধতি, কী ভাবে তা তথ্য আদানপ্রদান করে, কী ভাবে জলের তলায় লুকিয়ে থাকে, কী ভাবে টর্পেডো ছোড়ে— সেই সব তথ্যই রয়েছে।

ডুবোজাহাজের কার্যকারিতার পুরোটাই নির্ভর করছে শত্রুর চোখে ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতার উপর। জলের তলায় স্করপেন-এর এতটাই নিঃশব্দে কাজ করার কথা, যে তাকে চিহ্নিত করা যথেষ্ট কঠিন। কিন্তু সে জলের তলায় কতখানি শব্দ করছে, কোন তরঙ্গদৈর্ঘ্যে তথ্য আদানপ্রদান করছে, তা জানা হয়ে গেলে ডুবোজাহাজকে চিহ্নিত করে ধ্বংস করা কঠিন কাজ নয়। ফলে স্করপেন গোত্রের ছ’টি ডুবোজাহাজের আর কতখানি কার্যকারিতা থাকবে, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে।

গোটা ঘটনায় উদ্বিগ্ন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পর্রীকরের থেকে রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছেন তিনি। পর্রীকর বলেন, ‘‘গত কাল রাত ১২টা নাগাদ আমি বিষয়টি জানতে পারি। কী কী তথ্য ফাঁস হয়েছে, তা বোঝার জন্য নৌসেনা প্রধান অ্যাডমিরাল সুনীল লাম্বাকে সমস্ত নথি খুঁটিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছি।’’

ভারতের সঙ্গে ঝড় উঠেছে অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, মালয়েশিয়া, চিলিতেও। কারণ, অস্ট্রেলিয়া একই গোত্রের ডুবোজাহাজের বরাত দিয়েছে। আর অন্য দেশগুলি এখনই স্করপেন ব্যবহার করছে। নথি ফাঁসের গুরুত্ব বুঝতে তদন্তে নেমেছে ফরাসি সরকারও। প্রধানমন্ত্রী দফতর সূত্রে খবর, নথি আদৌ ফাঁস হয়েছে কি না, হলে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সে সম্পর্কে নিশ্চিত হলেই কূটনৈতিক স্তরে ফ্রান্সকে অভিযোগ জানানো হবে।

কোথা থেকে নথি ফাঁস হল, তা নিয়েও চাপানউতোর চলছে। এর আগে নৌসেনার ওয়ার রুম থেকে তথ্য চুরি নিয়ে হইচইয়ের সময়ও অভিযোগ উঠেছিল, স্করপেন সংক্রান্ত তথ্য ফাঁস হয়ে গিয়েছে। ওই ডুবোজাহাজ তৈরির বরাত দেওয়ার পিছনে ঘুষের ভূমিকা রয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছিল। সেই অভিযোগ শেয পর্যন্ত খারিজ হয়ে গেলেও ফাঁস হওয়া তথ্য হাত করেই ফরাসি সংস্থাটি বরাত পেয়েছে, বলে নৌসেনা মহলে গুঞ্জন এখনও বহাল। প্রতিরক্ষামন্ত্রী আজ দাবি করেছেন, বিদেশ থেকেই এই তথ্য ফাঁস হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। নৌসেনা সূত্রে বলা হচ্ছে, ফাঁস হওয়া নথিতে ফরাসি সংস্থার সঙ্গে অন্য দেশের চুক্তির তথ্যও রয়েছে। যা ভারতের হাতে থাকা সম্ভব নয়। অস্ট্রেলীয় সংবাদপত্রটিও জানিয়েছে, ২০১১-য় ভারতের জন্য ফ্রান্সেই এই নথি তৈরি হয়েছিল। ফ্রান্সের এক নৌসেনা অফিসার তা সরিয়ে ফেলেন। কিন্তু ডিসিএনএস ইঙ্গিত দিয়েছে, ভারত থেকেই তথ্য ফাঁস হয়েছে।

পর্রীকর ও নৌসেনা কর্তাদের অবশ্য দাবি, নথি ফাঁসে নিরাপত্তার ক্ষতি খুব একটা হয়নি। কারণ ফরাসি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হলেও ডুবোজাহাজগুলি তৈরি হচ্ছে এ দেশে। ফলে নির্মাতা সংস্থার কাছ থেকে ১০০ শতাংশ তথ্য বেরিয়ে যাওয়া অসম্ভব। নৌসেনার অবসরপ্রাপ্ত উপপ্রধান, ডুবোজাহাজ বিশেষজ্ঞ ভাইস অ্যাডমিরাল প্রদীপকুমার চট্টোপাধ্যায়ের যুক্তি, ‘‘প্রতিটি দেশ নির্দিষ্ট মাপকাঠির ভিত্তিতে ডুবোজাহাজ কেনে। সেই মাপকাঠি আর নৌসেনায় অন্তর্ভুক্তির পর যে মাপকাঠিতে ডুবোজাহাজ চলে, তার মধ্যে বিস্তর ফারাক। তাই নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্য ফাঁস হওয়া মানেই বিপদ নয়। পাশাপাশি, দু’টি স্করপেন ক্লাসের ডুবোজাহাজের কার্যক্ষমতা আলাদা। কে, কোথায়, কী ভাবে তাকে ব্যবহার করছে সেটাই আসল। যিনি জাহাজ চালান, তিনিই নির্দিষ্ট তথ্য জানতে পারেন। সেই তথ্য ফাঁস হওয়া সম্ভব নয়।’’

এর বিপরীতে নৌসেনার অনেক কর্তা আবার বলছেন, স্করপেন-এর শুধু টর্পেডোর বরাতই দেওয়া হয়নি। সেটা বাদ দিয়ে বাকি সব তথ্যই প্রকাশ্যে চলে এসেছে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিকে দিয়ে গোটা ঘটনার তদন্ত দাবি করেছে কংগ্রেস। আর এই বিতর্কের জেরে ভারতের ডুবোজাহাজ তৈরির প্রকল্পই ধাক্কা খেতে পারে বলে প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা। তাতে বিপাকে পড়বে নৌ-সেনা বাহিনী। ঠিক যে ভাবে বফর্স কেলেঙ্কারির জেরে ২৫ বছর আর কোনও কামান না-কেনায় সেনাবাহিনী সমস্যায় পড়েছে। অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার ডি বি শেখাতকরের কথায়, ‘‘ডুবোজাহাজ কেনার প্রক্রিয়া ধাক্কা খেলে পাকিস্তান-চিনেরই লাভ। তাই সেই প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়া উচিত।’’ অবসরপ্রাপ্ত কমোডোর উদয় ভাস্কর বলেন, ‘‘এমনিতেই নৌসেনার শক্তি প্রয়োজনের চেয়ে কম। স্করপেনের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় নৌসেনার মনোবল ধাক্কা খাবে। ডুবোজাহাজ কেনার প্রক্রিয়া পিছিয়ে গেলে নৌসেনার সমস্যা আরও বাড়বে।’’

ভারত মহাসাগর এলাকায় চিন যে ভাবে শক্তি বাড়াচ্ছে, তাতে বহু দিন ধরেই দুশ্চিন্তায় এ দেশের প্রতিরক্ষা কর্তারা। ভারতীয় উপকূল সংলগ্ন সমুদ্রে চিনের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির জন্যই ডুবোজাহাজের প্রয়োজন আরও বেশি। নৌসেনার চাহিদা অনুযায়ী, ভারতের হাতে ৩৬টি ডুবোজাহাজ থাকা উচিত। কিন্তু রয়েছে মাত্র ১৪টি। তাদের মধ্যে মাত্র একটি পরমাণু বিদ্যুতে চলে। বাকিগুলির অধিকাংশই জরাগ্রস্ত। সেই কারণেই স্করপেন-এর বরাত দেওয়া হয়েছিল। এই গোত্রের প্রথম ডুবোজাহাজ কালভারি-র সমুদ্রে কার্যক্ষমতা পরীক্ষার কাজ চলছে। এ বছরের শেষেই তার নৌসেনায় যোগ দেওয়ার কথা। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বাকি ডুবোজাহাজগুলিও তৈরির লক্ষ্য নিয়েছিল নৌসেনা।

Print Friendly, PDF & Email
basic-bank

Be the first to comment on "স্করপেন জলে নামার আগেই বিপত্তির ছায়া"

Leave a comment

Your email address will not be published.


*