সূর্যের খরতাপে শেষ বিকেলেও দুর্বিষহ অবস্থা। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে পাল্টে গেছে আবহাওয়ার চিত্র। রূদ্র রূপে ধরা দিয়েছে প্রকৃতি। তবুও থেমে নেই কারো পথচলা। শুক্রবার ২৫ চৈত্র; দিনভর গরমে নাভিশ্বাস জনজীবনে। ছুটির দিনের বিকেলে বন্ধুত্বের হাতছানি, ঘরের বাইরে নিয়ে আসে সবাইকে। স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে একের পর এক আসতে থাকে ছায়া সুনিবিড় সবুজে ঘেরা গুলশান পার্কে।
মামুনের পরই এসে হাজির হয় নাঈমা। দু’জনেই শুরু হয় আলোচনা। সামনে পহেলা বৈশাখ; বাজারে ইলিশে আগুন লেগেছে। মামুনের প্রশ্ন, এভাবে কী চলে? ৫০০ গ্রামের ইলিশের দাম হাঁকছে হাজার টাকা। অথচ এই সেদিনও ছিল চারশ’ থেকে পাঁচশ। আবার এক কেজি ওজনের ইলিশতো তিন হাজার টাকা। এমনি সময়ে এসে হাজির হন শান্ত; থামিয়ে দিয়ে বলে বসল, পহেলা বৈশাখ ইলিশ না খেলে কী হয়? এমনি মেজাজটা গরম; তার ওপর এমন প্রশ্নে ক্ষেপে উঠল মামুন; বলল বছরের এই একটি দিনে পান্তার সঙ্গে ইলিশতো চাই-ই।
নাঈমা জানতে চাইল কোন বাজারে গিয়েছিলেন? বাজারভেদে দামের ব্যাপক হেরফের আছে। কারওয়ান বাজার একদামতো; হাতিরপুলে আরেক দাম। ক্ষুব্ধ মামুন এবার ফুঁসে উঠল; বলল, ইলিশ কেনার জন্য কী এই বাজার সেই বাজার ঘুরতে হবে? এ সময়ে এসে হাজির পাপড়ি মাহমুদ; বলল, হাতিরপুলে গিয়েছিলাম; দুটি ইলিশের দাম হাঁকল ২০ হাজার টাকা। কী বলব, এক কেজি ৮০০ গ্রাম ওজনের দুটি ইলিশ ১৬ হাজার টাকায় বিক্রিও হলো।
শান্তর মন খুবই ভালো; জানালো এক মাস আগেই রামপুরা বাজার থেকে ১০টি ইলিশ কিনে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রেখেছে। পাপড়ির কাছে জানতে চাইল, শেষ পর্যন্ত কিনেছেন ইলিশ? মৃদু ক্ষোভের সঙ্গে জবাব দিল, চারশ’ থেকে পাঁচশ’ গ্রামের দুটি কিনেছেন, সাড়ে ছয়শ’ টাকা করে। এই আলোচনার ফাঁকে নাঈমা বলল, ঘুরতে না চাইলে স্বপ্ন, আগোরা, মিনা বাজারের মতো ফিক্সড রেটের ডিপার্টমেন্টাল শপে যান। শুনেছি স্বপ্নে নাকি ২০০ টাকার কমেও ইলিশ মিলছে। খোঁজ নিয়েছেন কী? শান্ত এবার কিছুটা অশান্ত হয়েই বলল খোঁজ নিয়েছি; ১৯২ টাকা করে ইলিশ মিলছে; তবে দেখতে জাটকার মতোই; লেজ মাথা বাদ দিলে এক পিস, বেশি হলে দু’পিস মাছ মিলবে। আর সেগুলোতো ক্লোল্ড স্টোরেজে ছিল কমপক্ষে নয় মাস। নিশ্চয়ই খেতে স্বাদ হবে না। আসুন, ইলিশ বন্দনার পরিবর্তে পহেলা বৈশাখ অন্য মাছ দিয়ে উদযাপন শুরু করি এতক্ষণ সবার কথা শুনে মামুনের আহ্বান। কিন্তু সাড়া দিল না কেউ। পাপড়ির কথা বছরের একটি দিনে ছোট হোক বড় হোক পান্তা-ইলিশ চাইই।
আলোচনা চলছে; সূর্যও ক্রমেই পশ্চিম আকাশে লাল আভা ছড়িয়ে হারিয়ে যেতে থাকল। এমনই পরিবেশে দক্ষিণের মৃদুমন্দ বাতাস দোলা দিল সবাইকে। ইলিশ বন্দনার এমন সময়ে রাজনীতি নিয়ে কথার আগ্রহ দেখাল শান্ত। সাড়াও দিল অন্যরা। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নাঈমা বলল, অবশেষে সময়ের আয়না : ইলিশ বন্দনা বর্জনে অর্জন বিএনপি ঘোষণা করল, ইউপি নির্বাচনে তারা থাকছে। অথচ এতদিন শাহ মোয়াজ্জেম, আবদুল্লাহ আল নোমান থেকে শুরু করে দলের শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতাই নির্বাচন বর্জনের কথা বলে আসছিলেন। কেন এমন হলো জানতে চাইল শান্ত? নাঈমা জানাল, বর্জনে অর্জন নেই বলেই বিএনপি নির্বাচনে থাকছে বলে পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। এর সঙ্গে কী সবাই একমত, জানতে চাইল পাপড়ি মাহমুদ। ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে মামুনের কথা একটাই, এত সহজে এমন ঘোষণা দেয়ার কথা নয় বিএনপির। এর পেছনে অন্য রহস্য লুকিয়ে আছে। যেখানে প্রথম দু’দফার নির্বাচনে দেড় শতাধিক ইউনিয়নে বিএনপি প্রার্থীই দিতে পারেনি; নির্বাচনী ফলাফলে চরম ভরাডুবির ঘটনা ঘটেছে; হামলা-মামলায় দিশেহারা তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। তারপরও নির্বাচনে থাকার ঘোষণা! শান্ত যোগ করে, পর্দার আড়ালে হয়তো অন্য কোনো খেলা রয়েছে; যা গুলশান পার্কের পূর্ব পাশে বিএনপির চেয়ারপারসনের অফিসের শীর্ষ নেতারাই বলতে পারবেন। নাঈমার দাবি, সবদিক বিবেচনা করেই নির্বাচনে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। হয়তো আপাতদৃষ্টিতে তার সুফল দেখা না গেলেও ভেতরে ভেতরে তারা তা ভোগ করছে। পাপড়ি যোগ করে, একটা কিছু যে আছে; তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে বিএনপির এই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা থেকে সরে আসায় জনমনে একটি আশঙ্কার ইতি ঘটেছে। কেউ কেউ মনে করেন, নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলে, প্রতিবাদে কর্মসূচি দিতে হতো। তীব্র এই গরমে রাজপথে কর্মসূচির তেমন জমত না। রাজপথ দখলের উদ্যোগ মাঠে মারা যেত। বর্জনে অর্জন নেই-তাই নির্বাচনে থাকলেও, গ্যাস-বিদ্যুৎ ইস্যুতে বিএনপি সরকারকে আন্দোলনের হুমকি দিয়েছে জানিয়ে শান্ত বলল, গরমে নরমে বিএনপি সামনে এগিয়ে যাবে। মামুন বলল, বিএনপিকে গণমানুষের দাবির সঙ্গে একাত্ম হয়ে চলতে হবে। তবেই আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা বাড়বে। জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন বাদ দিতে হবে।
নাঈমার মতে, অতীতের জ্বালাও-পোড়াওয়ের জন্য জামাত দায়ী। হালে তাদের রাখিবন্ধন কিছুটা শিথিল হয়েছে। পাপড়ি যোগ করে, আন্দোলনের নেতৃত্ব খালেদা জিয়ার বলে, ধ্বংসাত্মক ঘটনার দায় বিএনপিকে নিতে হবে। আন্দোলনে নেতিবাচক ভাব পরিহার করে সামনে তাদের পথ চলতে হবে। ‘এই পথ চলাতেই আনন্দ’ সুরে সুরে গেয়ে উঠল নাঈমা। হেসে উঠল বন্ধুরা। পার্কের লাইটগুলো জ্বলে উঠল; তবুও অন্ধকার দানা বাঁধছে। মামুন, পাপড়ি ও শান্ত উঠে দাঁড়াল। পহেলা বৈশাখের পর আবারো দেখা হবে, কথা হবে; পরস্পর করমর্দন করে যে যার গন্তব্যের উদ্দেশে পা বাড়াল।
লেখক : মাহমুদ আল ফয়সাল, সাংবাদিক ও কলাম লেখক
লেখক : মাহমুদ আল ফয়সাল, সাংবাদিক ও কলাম লেখক
সূত্র: মানবকণ্ঠ

Be the first to comment on "ইলিশ বন্দনা বর্জনে অর্জন"