শিরোনাম

কক্সবাজারে উপকূল ‘অরক্ষিত’ থাকায় ক্ষয়ক্ষতি বেশি

নিউজ ডেস্ক: ঘূর্ণিঝড়ে রোয়ানুর আঘাতে কক্সবাজারে প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির জন্য নতুন বেড়িবাঁধ নির্মাণ না হওয়া এবং ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ সংস্কার না করাকে দায়ী করছেন স্থানীয়রা।

শনিবার মাঝারি মানের এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস এবং গাছ ভেঙে ও বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়ে উপকূলীয় সাত জেলায় ২৪ জন নিহত হন, যাদের তিনজন কক্সবাজারের।

এছাড়া বসতবাড়ি, বেড়িবাঁধ এবং লবণ ও চিংড়ি ঘেরের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এ জেলায়।

এর আগে ২০১৫ সালের জুলাইয়ে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় ‘কোমেন’ এর আঘাতে ৪ জন ও ২০১৩ সালের মে মাসে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় ‘মহাসেন’ এর আঘাতে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এই দুটি ঘূর্ণিঝড়ও ছিল রোয়ানুর মতো দ্বিতীয় ক্যাটাগরির।

এবার কক্সবাজারে ক্ষয়ক্ষতির জন্য ঝড় কখন আঘাত হানবে সে সম্পর্কে ‘সঠিক’ তথ্য না পাওয়া এবং উপকূলের বিভিন্ন জায়গায় বেড়িবাঁধের ভাঙনকে দায়ী করছেন স্থানীয়রা।

কক্সবাজারের প্রায় সব উপজেলায় বেড়িবাঁধে আগে থেকেই ভাঙন ছিল বলে জানিয়েছেন তারা।

ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক কোনো ধারণা দিতে না পারলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কক্সবাজার কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শবিবুর রহমান বলেছেন, রোয়ানুর আঘাতে কুতুবদিয়া, মহেশখালী, পেকুয়া ও টেকনাফের উপকূলীয় এলাকায় ৪৭ কিলোমিটারের মতো বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন তারা। এরমধ্যে সম্পূর্ণভাবে ১৪ কিলোমিটার এবং আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩৩ কিলোমিটার।

“রোববার আমি কুতুবদিয়া ও পেকুয়ার ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধের এলাকা পরিদর্শন করেছি। জলোচ্ছ্বাসের কারণে বেড়িবাঁধের ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণে কাজ চলছে। দুয়েকদিনের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধের সঠিক পরিমাণ নির্ধারণ করা হবে।”

তবে ৮০ কিলোমিটারের বেশি বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে দাবি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের।

কুতুবদিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুল বশর চৌধুরী বলেন, “বিভিন্ন সময় ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ সংস্কার ও নির্মাণ না করায় এমনিতেই কুতুবদিয়ার অধিকাংশ এলাকা অরক্ষিত ছিল। ফলে এবার ঘূর্ণিঝড়ে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের কারণে বেড়িবাঁধের ক্ষতিগ্রস্ত অংশ দিয়ে দ্রুত পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে। এ কারণে কুতুবদিয়ায় সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি ঘটেছে।”

এখানে তিনজনের প্রাণহানি এবং তিন হাজারের বেশি বাড়ি আংশিক ও সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে জানান তিনি।

এছাড়া উপজেলার আলী আকবর ডেইল, উত্তর ধুরুং, বড়ঘোপ, কৈয়ারবিল, লেমশীখালী ও দক্ষিণ ধুরুং ইউনিয়নের ৪১ কিলোমিটারের মধ্যে ৩০ কিলোমিটারের বেশি বেড়িবাঁধ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

নুরুল বশর বলেন, “বাতাসের গতিবেগ কম হলেও ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর কারণে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস কোনো অংশে ’৯১ এর ঘূর্ণিঝড়ের জলোচ্ছ্বাসের চেয়ে কম ছিল না।”

তবে ঘূর্ণিঝড়টি দিনের বেলায় আঘাত হানায় এবং সরকারিভাবে প্রচার ও উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে আগের চেয়ে সচেতনতা বাড়ার কারণে এবারের জলোচ্ছ্বাসে ক্ষয়ক্ষয়তি সেই তুলনায় কম হয়েছে বলে মনে করছেন তিনি।

কুতুবদিয়ার দক্ষিণ ধুরুং ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন আল আজাদ বলেন, “ঘূর্ণিঝড় শনিবার দুপুর থেকে সন্ধ্যার মধ্যে উপকূল অতিক্রম করবে বলে আবহাওয়া অধিদপ্তর প্রচার করেছিল। লোকজন প্রস্তুতি নিয়েছিল দুপুরের আগেই খাবার খেয়ে রাতের খাবার প্রস্তুত করে নিরাপদ আশ্রয়ে যাবে। কিন্তু সকালেই ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানে। ফলে অনেকের প্রস্তুতি থাকলেও নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারেনি।”

ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু নিয়ে শুক্রবার দিনভর আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিশেষ বুলেটিনে শনিবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা নাগাদ এই ঝড় বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়। শেষ মুহূর্তে ওই দিন মধ্যরাত পেরিয়ে পৌনে ২টার বুলেটিনে বলা হয়, ঘূর্ণিঝড়টি সকাল বা দুপুরে আঘাত হানতে পারে।

আজাদ জানান, ঝড়ের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাসে দক্ষিণ ধুরুংয়ে অনেকের বাড়ি ৫ থেকে ৬ ফুটের বেশি পানির নিচে তলিয়ে যায়। সম্পূর্ণভাবে তলিয়ে যায় অনেকের আসবাবপত্র।

“পানি নেমে যাওয়ার পরও লোকজনের দুর্ভোগের অন্ত নেই। দুর্গত লোকজনের বাড়িতে রান্না করারও অবস্থা নেই।”

ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে মহেশখালীর ধলঘাটা, কুতুবজোম ও মাতারবাড়িতে প্রাণহানি না ঘটলেও বসতবাড়ি ও সম্পদের ‘ব্যাপক’ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

ধলঘাটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কামরুল হাসান বলেন, “ধলঘাটাকে রক্ষায় নির্মিত বেড়িবাঁধ ’৯১ এর ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকে সংস্কার করা হয়নি। প্রতিদিনই জোয়ার-ভাটায় ধলঘাটার এক-তৃতীয়াংশের বেশি এলাকা প্লাবিত হয়। ফলে ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাসের কারণে বরাবরই এ ইউনিয়ন ছিল অরক্ষিত। এবারে জলোচ্ছ্বাসে পুরো ইউনিয়নই পানিতে তলিয়ে যায়।”

ইউনিয়নের ২২ কিলোমিটারের বেশি আগে থেকে ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ সম্পূর্ণভাবে বিলীন, দুই হাজারের বেশি বসতবাড়ি, মাঠে থাকা ছয় হাজার একরের বেশি লবণ (মৌসুমের শেষ পর্যায়ের), দুই শতাধিক চিংড়ি ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে দাবি তার।

বেড়িবাঁধ ও রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এতে দুর্গত লোকজনের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

মাতারবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ উল্লাহ বলেন, ইউনিয়নের ১২ কিলোমিটারের বেশি বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া এক হাজারের বেশি বসতবাড়ি, শতাধিক চিংড়ি ঘের এবং দেড় হাজারের বেশি একর মাঠের লবণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

পেকুয়া উপজেলা চেয়ারম্যান শাফায়াত আজিজ রাজু বলেন, গত বছর ঘূর্ণিঝড় কোমেনের আঘাতে পেকুয়ার মগনামা ও উজানটিয়া ইউনিয়নের ১২ কিলোমিটারের বেশি বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ফলে বেড়িবাঁধের ক্ষতিগ্রস্ত অংশ দিয়ে এ দুই ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা প্রতিদিনই জোয়ার-ভাটার সময় প্লাবিত হত।

শনিবার রোয়ানুর আঘাতে মগনামা ও উজানটিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধের অংশ দিয়ে সহজেই পানি ঢুকে ব্যাপক এলাকা প্লাবিত হয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধের আরও বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে জানান তিনি।

টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুর হোসেন বলেন, এর আগে বিভিন্ন সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগে টেকনাফ-শাহপরীর দ্বীপ সড়কের শাহপরীরদ্বীপ এলাকার আড়াই কিলোমিটারের বেশি বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

“দীর্ঘদিন ধরে ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ সংস্কার না হওয়ায় প্রতিদিনের জোয়ার-ভাটায় দেশের মূল-ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় শাহপরীর দ্বীপ। রোয়ানুর সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে দ্রুত পানি ঢুকে ইউনিয়নে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

“পানিতে তিন শতাধিক বসতবাড়ি সম্পূর্ণভাবে বিলীন হয়ে গেছে। ইউনিয়নের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে ঘোলারপাড়া গ্রাম।”

ঝড়ে উপকূলীয় এলাকায় বেড়িবাঁধ, সড়ক, বসতবাড়ি ও অবকাঠামোসহ সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণের জন্য জেলা প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন জানান।

“আশা করছি আগামী ২/১ দিনের মধ্যে ক্ষয়ক্ষতির সঠিক তথ্য হাতে আসবে,” বলেন তিনি।

ঝড়ে কক্সবাজার ছাড়াও চট্টগ্রাম, ভোলা ও পটুয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, ঝালকাঠি, বরিশালসহ উপকূলীয় জেলাগুলোতে হতাহতের পাশাপাশি ঘরবাড়ি এবং সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email
basic-bank

Be the first to comment on "কক্সবাজারে উপকূল ‘অরক্ষিত’ থাকায় ক্ষয়ক্ষতি বেশি"

Leave a comment

Your email address will not be published.


*