‘দাদাদের’ ছত্রচ্ছায়ায় বেলাগাম দালাল-রাজ

নিউজ ডেস্ক :  চেষ্টা অনেক হয়েছে। কিন্তু রাজ্যের প্রথম এবং প্রধান সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল এসএসকেএমের চৌহদ্দি থেকে দালাল-রাজ হঠানো যায়নি— এই অভিযোগ অনেক দিনের। বরং তা এতটাই বেড়েছে যে, রোগীর বাড়ির লোক সেজে তাঁরা চিকিৎসকদের উপরে হামলাও চালাচ্ছেন। অভিযোগকারীরা এসএসকেএমেরই জুনিয়র ডাক্তারদের একটা বড় অংশ। তাঁদের দাবি, সোমবার রাতে হাসপাতালে হামলার ঘটনায় মূল হোতা হল ওই দালালেরা।

কিন্তু দালালেরা হঠাৎ রোগীর বাড়ির লোক সেজে ডাক্তারদের মারধর করতে যাবেন কেন? তাঁদের কাজ তো টাকার লেনদেনেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা।

ডাক্তারদের ব্যাখ্যা— দালালেরা মোটা টাকা নিয়ে রোগী ভর্তি করেন। অতএব, চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ উঠলে রোগীর বাড়ির লোকের হয়ে কথা বলার দায়িত্ব তাঁদের উপরেও খানিকটা বর্তায়। তা না-হলে ভবিষ্যতে দালালির বরাতে ভাঁটা পড়তে পারে। তা ছাড়া, প্রকাশ্যে ডাক্তারদের উপরে চড়াও হলে হাসপাতালে তাঁদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপ্তিটাও সবাইকে বোঝানো যায়। তাতে ভবিষ্যতে আরও মোটা টাকায় শয্যা জোগাড় করা, আইসিইউ বা ট্রলি জুটিয়ে দেওয়ার কাজ মেলে। যার হাত ধরে ‘ব্যবসা’য় পসার বাড়ে।

সোমবার রাতে অশোক রাম নামে এক রোগীর মৃত্যুর পরে সঞ্জয় দাস ওরফে সঞ্জু নামে এক দালালের নেতৃত্বেই প্রথম তাঁদের উপরে হামলা চালানো হয়েছে বলে দাবি করেছেন জুনিয়র ডাক্তারদের একাংশ। সঞ্জয়ের বাড়ি ভবানীপুরের বিজয় বসু রোডে মৃত অশোক রামের বাড়ির পিছনে। তিনি হাসপাতালে অস্থায়ী চতুর্থ শ্রেণির কর্মী হিসেবে কাজ করেন।

চিকিৎসকদের দাবি, শাসক দলের নেতাদের দাক্ষিণ্যে সঞ্জয়ের দাপট হাসপাতাল জুড়ে। এসএসকেএমে মদন মিত্রের অন্যতম সহযোগী হিসেবে তিনি পরিচিত। ডাক্তারদের অভিযোগ, ‘‘২০ হাজার, ৩০ হাজার এমনকী ৫০ হাজারেরও বেশি টাকায় এক-একটা বেড বিক্রি করে সঞ্জয়। সঞ্জু দালাল নামে আমরা সবাই ওঁকে চিনি। অশোককেও উনি টাকা নিয়ে ভর্তি করেছিলেন। তাই সব রকম চেষ্টার পরেও যখন তাঁর মৃত্যু হয়, তখন বাড়ির লোকের সামনে নিজেদের ক্ষমতা দেখাতে সঞ্জয় ওঁর দলবল নিয়ে আমাদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েন।’’ যেহেতু সঞ্জয় শাসক দলের নেতার মদতে পুষ্ট, তাই পাড়ায় নিজের ও দলের প্রভাব অটুট রাখতেও তিনি ডাক্তারদের উপরে হামলায় নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে খবর।

জুনিয়র ডাক্তারদের কথায়, হাসপাতালের প্রশাসনিক ভবনের ঠিক উল্টো দিকে রোগী কল্যাণ সমিতির অফিসটি এখন দালালদের আখড়া। অভিযোগ, ওখান থেকেই সঞ্জয় ও অন্য দালালেরা ‘অপারেশন’ চালান। বারবার অধ্যক্ষ আর সুপারকে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে বললেও তাঁরা কান দেননি। মঙ্গলবার অধ্যক্ষের ঘরে বিক্ষোভ দেখানোর সময়ে জুনিয়র ডাক্তারেরা ১০ দফা দাবিপত্র পেশ করেন। সেখানেও প্রধান দাবির মধ্যে ছিল, হাসপাতালে দালাল-রাজ খতম করা, ‘ক্যাচ কেস’ অর্থাৎ বিভিন্ন নেতা-মন্ত্রী বা ভিআইপি-র সুপারিশ নিয়ে আসা রোগীকে আগেভাগে শয্যা দেওয়ার অলিখিত নিয়ম বন্ধ করা এবং রোগীকল্যাণ সমিতির অফিসকে দালালমুক্ত করা।

এসএসকেএমে এক-এক সময়ে শাসকদলের এক-এক নেতার প্রভাব ছিল এবং রয়েছে। এবং তাঁদের ছত্রচ্ছায়াতেই দালালেরা ফুলেফেঁপে উঠেছেন বলে অভিযোগ জুনিয়ার ডাক্তারদের। যেমন, আগে ছিল মদন মিত্রের দাপট। তখন হাসপাতালে রাজত্ব ছিল শাঁখারিটোলার ছেলেদের। এখন সেখানে এসেছেন ফিরহাদ হাকিম, রমরমা বেড়েছে চেতলা এলাকার ছেলেদের। তবে তার মধ্যেও মদন-ঘনিষ্ঠ কিছু ছেলের প্রভাব অটুট। তার মধ্যে অন্যতম এই সঞ্জয়। ফিরহাদ অবশ্য বলেন, ‘‘সঞ্জয় নামে কাউকে চিনি না। হাসপাতালে রোগী কল্যাণ সমিতির অফিসেও আমি কখনও যাই না।’’

তবে শাসক দলের সঙ্গে সঞ্জয়ের ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ এ দিন মিলেছে তাঁর পাড়া বিজয় বসু রোডে গিয়ে। তাঁর প্রতিবেশীরা এবং তাঁর মা ময়না দাসের কথায়, ‘‘মদনদা খুব ভালবাসেন সঞ্জয়কে, জানেন ও কেমন ছেলে। মদনদা খুব ভাল লোক। ওঁর জন্যই আমার ছেলে আজ এই জায়গায় পৌঁছেছে।’’ তবে ডাক্তারদের উপরে হামলার যে অভিযোগ সঞ্জয়ের বিরুদ্ধে উঠেছে, তা পুরোপুরি খারিজ করেছেন তাঁরা। সঞ্জয় টাকা নিয়ে রোগী ভর্তি করেন এবং অশোককেও ভর্তির জন্যও টাকা নিয়েছেন, এই অভিযোগও তাঁরা উড়িয়ে দিয়েছেন।

সূত্র : আনন্দবাজার প্রত্রিকা

Print Friendly, PDF & Email
basic-bank

Be the first to comment on "‘দাদাদের’ ছত্রচ্ছায়ায় বেলাগাম দালাল-রাজ"

Leave a comment

Your email address will not be published.


*