শিরোনাম

বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো

নিউজ ডেস্ক : প্রভাবশালী রাষ্ট্রনায়ক ফিদেল কাস্ত্রো আর নেই। ৯০ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একাধারে প্রায় চার যুগ শাসন করে যাওয়া মহান এই বিপ্লবী নেতা। একসময়কার বিপ্লবী কাস্ত্রো সুদীর্ঘকাল কিউবার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনের পর অসুস্থতার কারণে ২০০৮ সালের শুরুতে ছোট ভাই রাউল কাস্ত্রোর কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। কাস্ত্রো কিউবান বিপ্লবের মাধ্যমে পূর্বতন একনায়ক রাষ্ট্রপতি ফুলগেনসিও বাতিস্তাকে অপসারণ করেন এবং একদলীয় কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৬ সালের ১৩ আগস্ট কিউবার পূর্বাঞ্চলে স্পেনীয় বংশোদ্ভূত এক আদিবাসী পরিবারে কাস্ত্রোর জন্ম। তার বাবা ছিলেন ছোট্ট আখের খামারি। আর তাই তার শৈশব মোটেও সচ্ছল ছিল না। আইন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর হাভানায় আইনজীবী হিসেবে পেশাজীবন শুরু করেন তিনি। তার দরিদ্র মক্কেলদের পক্ষে লড়ে অল্প সময়ের মধ্যেই সুনাম এবং জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। সেখান থেকেই সক্রিয় দলীয় রাজনীতি শুরু করেন।

এরপর ১৯৪৭ সালে নবগঠিত কিউবান পিপলস পার্টিতে যোগ দেন কাস্ত্রো। রাজনীতিতে যোগ দিয়েই তুখোড় বক্তা কাস্ত্রো তরুণদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। ১৯৫২ সালে তিনি প্রথমবারের মতো দলীয় কংগ্রেসের সদস্য প্রার্থী হন। নির্বাচনে পিপলস পার্টির যখন বিজয়ের ঠিক দ্বারপ্রান্তে, ঠিক তখনই জাতীয় নির্বাচনের আগে জেনারেল বাতিস্তা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে কিউবার ক্ষমতা দখল করেন। ফলে নির্বাচন বাতিল হয়ে যায়। রাজনৈতিক সুবিধাবঞ্চিত কাস্ত্রো তাই হাতে তুলে নিলেন অস্ত্র। শুরু হলো বিপ্লবী কাস্ত্রোর নতুন জীবন।

১৯৫৩ সালের সশস্ত্র দল নিয়ে মনকাডা আর্মি ব্যারাকে হামলা করেন কাস্ত্রো। সংঘর্ষে কাস্ত্রোর দল পরাজিত হয়। সামরিক শাসক বাতিস্তার নির্দেশে কাস্ত্রোর ৮০ জন সহযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়। সৌভাগ্যক্রমে বাস্তিতার হত্যার আদেশ থেকে বেঁচে বেসামরিক কারাগারে ঠাঁই পান কাস্ত্রো। কিন্তু কারাগারেও তাকে বিষ খাইয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়। শেষ পর্যন্ত বিশ্ব জনমতের কথা বিবেচনা করে কাস্ত্রোকে হত্যা না করে বিচারের মুখোমুখি করেন বাতিস্তা। মনকাডা হামলায় অভিযুক্ত হিসেবে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ফিদেল যে জবানবন্দি দিয়েছিলেন তার মধ্য দিয়ে কিউবার রাজনৈতিক সংকট এবং তার সমাধানের পথ-নির্দেশ করেন তিনি। তার এ বক্তৃতা আলোড়ন তোলে গোটা কিউবায়, জননায়কে পরিণত হন ফিদেল। বিচারে তার ১৫ বছরের কারাদণ্ড হলেও প্রবল জনমতের কাছে মাথা নত করে দুই বছরের মাথায় তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন বাতিস্তা।

জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর বিপ্লবী দল গড়ার লক্ষ্যে মেক্সিকোয় পাড়ি জমান কাস্ত্রো। সেখানে একটি গেরিলা দল গঠন এবং পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র জোগাড়ের পর চে গুয়েভারা, জুয়ান আলমেইডাসহ একটি বিপ্লবী দল নিয়ে ১৯৫৬ সালে কিউবায় ফিরে আসেন কাস্ত্রো। ১৯৫৩ সালের ২৬ জুলাই মনকাডায় সেই হামলার নামানুসারে ফিদেল কাস্ত্রোদের এই গেরিলা দল ‘জুলাই টুয়েন্টি সিক্স মুভমেন্ট’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। অন্যদিকে জেনারেল বাতিস্তা গেরিলা নিধন অভিযান আরও জোরদার করেন। গেরিলারা সিয়েরা মায়েস্ত্রা পর্বত ছেড়ে একের পর এক শহর দখল করতে থাকে। স্থানীয় জনতা গেরিলাদের অভ্যর্থনা জানায়। ১৯৫৮ সালের মাঝামাঝি বাতিস্তার প্রায় এক হাজার সেনা গেরিলাদের হাতে প্রাণ হারালে যুক্তরাষ্ট্র বিমান, বোমা, জাহাজ ও ট্যাংক পাঠিয়ে গেরিলাদের হঠানোর চেষ্টা চালায়। কাস্ত্রোর সেনারা চারদিক থেকে রাজধানী হাভানাকে ঘিরে ধরতে শুরু করলে ১৯৫৯ সালের ১ জানুয়ারি কিউবা ছেড়ে পালিয়ে যান জেনারেল বাতিস্তা।

১৯৫৯ সালে দক্ষিণপন্থী স্বৈরাচারী শাসক বাতিস্তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে ফিদেল কাস্ত্রোর গেরিলা বাহিনী। নতুন বিপ্লবী সরকারকে সর্বপ্রথম মান্যতা দিতে সে দিন যারা এগিয়ে এসেছিল, মার্কিন সরকার তাদের অন্যতম। কিন্তু মার্কিন মালিকদের জমি অধিগ্রহণ করে নেওয়া এবং কোনো ন্যায়বিচারের ব্যবস্থা না করেই বাতিস্তা সরকারের সমর্থকদের গুলি করে হত্যার অভিযোগকে কেন্দ্র করে দুই দেশের সম্পর্ক দিন দিন অবনতির দিকে যায়। এ ছাড়াও মার্কিন গোয়েন্দা চক্রের বিরুদ্ধে কাস্ত্রোকে খুন করার বিভিন্ন প্রয়াসের অভিযোগ ওঠে। দুই দেশের তিক্ত সম্পর্ক নতুন মাত্রা পায় সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ফিদেল কাস্ত্রোর মৈত্রী সম্পর্ককে ঘিরে, যার পরিণামে শীতল যুদ্ধ বিস্তৃত হয় পশ্চিম গোলার্ধেও।

২০০৬ সালের জুলাইতে গুরুতর অসুস্থ হওয়ার পর থেকে ফিদেল কাস্ত্রো অনেকটাই নিজেকে গুটিয়ে নিতে বাধ্য হন। জীবনের শেষ কয়েকটি বছর জনসমক্ষে তাকে তেমনভাবে আর আসতে দেখা যায়নি। তারপরও স্থানীয় এবং কিছু বিদেশি সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে তার আলাপচারিতার বিবরণ থেকে সেই বিপ্লবের প্রতীক এবং লাতিন আমেরিকার অবিসংবাদিত নায়ক ফিদেলকে চিনে নিতে অসুবিধা হয়নি বিশ্ববাসীর। অসংখ্যবারের হত্যা পরিকল্পনা, অর্ধ শতাব্দীব্যাপী নিষেধাজ্ঞা ও বিধিনিষেধ আরোপ করেও যে যুগকে অকালে শেষ করা যায়নি। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে এবং সীমাবদ্ধ জীবনকালের বাধ্যবাধকতা মেনে শেষ হয়েছে কিউবা-মার্কিন সম্পর্কের একটি যুগ, যা চিহ্নিত হয়ে থাকবে ফিদেল কাস্ত্রোর নামে চিরদিন।

Print Friendly, PDF & Email
basic-bank

Be the first to comment on "বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো"

Leave a comment

Your email address will not be published.


*