যুদ্ধাপরাধ: জামালপুরের ৮ আসামির রায়ের অপেক্ষা

নিউজ ডেস্ক: ইসলামী ব্যাংকের সাবেক এক পরিচালকসহ জামালপুরের আট আসামির যুদ্ধাপরাধের মামলার রায় জানা যাবে আজ সোমবার।

বিচারপতি আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এই রায় ঘোষণা করবে।

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রেজিয়া সুলতানা চমন রোববার বলেন, “রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা এই মামলাটি আজ কার্যতালিকায় এলে বিচারক রায় ঘোষণার দিন ঠিক করে দেন।”

এর আগে প্রসিকিউশন ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে গত ১৯ জুন আদালত মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমান (সিএভি) রাখে।

আট আসামি হলেন- ইসলামী ব্যাংকের সাবেক পরিচালক শরীফ আহাম্মেদ ওরফে শরীফ হোসেন, মো. আশরাফ হোসেন, মো. আব্দুল মান্নান, মো. আব্দুল বারী, হারুন, মো. আবুল হাশেম, অ্যাডভোকেট মো. শামসুল হক ওরফে ‘বদর ভাই’ এবং এস এম ইউসুফ আলী।

এদের মধ্যে গ্রেপ্তার শামসুল ও ইউসুফ কারাগারে আছেন। বাকি ছয়জনকে পলাতক দেখিয়েই এ মামলার বিচার চলে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধিতায় হত্যা, অপহরণ, আটক, নির্যাতন, লুটপাট ও গুমের মত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ রয়েছে এই আট আসামির বিরুদ্ধে।

যুদ্ধাপরাধের পাঁচ অভিযোগে গত বছর ২৬ অক্টোবর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এই আটজনের বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল।

যুক্তিতর্কের শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের আরজি জানায়। অন্যদিকে আসামিপক্ষ অভিযোগ থেকে অব্যাহতির আবেদন করে।

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করের প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ ও তাপস কান্তি বল। অন্যদিনে গ্রেপ্তার দুই আসামির পক্ষে ছিলেন আইনজীবী সৈয়দ মিজানুর রহমান, ব্যারিস্টার এহসান এ সিদ্দিকী ও গাজী এম এইচ তামিম। পলাতক আসামিদের পক্ষে ছিলেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আব্দুস সোবহান তরফদার।

যুক্তি তর্কের শুনানির দিন তুরিন আফরোজ বলেন, ‘আমরা সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের আরজি জানিয়েছি। সাক্ষ্য ও তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে আসামিদের সর্বোচ্চ দণ্ড হবে বলে প্রত্যাশা করি।’

অন্যদিকে গাজী তামিম বলেন, ‘অভিযোগ খণ্ডন করে আমরা আসামিদের খালাসের আরজি জানিয়েছি।’

চলতিবছর ২৯ এপ্রিল এই আট আসামির বিরুদ্ধে প্রসিকউশনের দাখিল করা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল।

গত ২ মার্চ তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর পুলিশ শামসুল ও ইউসুফকে গ্রেপ্তার করে।

নিয়ম অনুযায়ী বাকিদের আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হলেও তারা তা করেনি।

গ্রেপ্তার শামসুল হক জামালপুর জেলা জামায়াতের সাবেক আমির এবং সিংহজানি স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক ইউসুফও একসময় জামায়াতের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন।

এই দুইজন একাত্তরে রাজাকার বাহিনীতে এবং বাকি ছয়জন আলবদর বাহিনীতে ছিলেন বলে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার অভিযোগ।

পাঁচ অভিযোগ

প্রথম অভিযোগ: একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামীর নেতা ও শান্তি কমিটির সদস্য শামসুল হক ও এস এম ইউসুফ আলী ও তাদের অন্য সহযোগীরা তৎকালীন জামালপুর মহকুমায় সাধারণ মানুষকে অপহরণ, নির্যাতন, হত্যা ও অগ্নিসংযোগের মত মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটনায়। শাস্তি কমিটির পরামর্শ ও নির্দেশনায় পাকিস্তানি বাহিনী ও স্থানীয় আল-বদর বাহিনী দুই আসামির অংশগ্রহণ ও সহযোগিতায় একাত্তরের ২২ এপ্রিল থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত জামালপুরে হত্যা-ধ্বংস চালায়; স্বাধীনতাকামী এক হাজার লোককে হত্যা করে তারা।

এ ঘটনায় শামসুল হক ও এস এম ইউসুফ আলীর বিরুদ্ধে অপহরণ, নির্যাতন, হত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ আনা হয়েছে।

দ্বিতীয় অভিযোগ: আসামি আশরাফ হোসেন, শরীফ আহমেদ, আব্দুল মান্নান, মো. হারুন ও আব্দুল বারী ১৯৭১ সালের ৭ জুলাই থেকে ১৪ জুলাই এবং ২২ জুলাই মধ্যরাত পর্যন্ত জামালপুরের সরিষাবাড়ী থানার মইষ ভাদুরিয়া ও ধূপদহ গ্রামের শহীদ আব্দুল হামিদ মোক্তারের বাড়ি, মো. সাইদুর রহমান ভূঁইয়ার বাড়ি, আমির আলী খানের বাড়ি, পিটিআই হোস্টেলের টর্চার ক্যাম্প ও জামালপুর শ্মশানঘাটে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে।

এ ঘটনায় শরীফ হোসেন, মো. আশরাফ হোসেন, মো. আব্দুল মান্নান, মো. আব্দুল বারী ও হারুনের বিরুদ্ধে অপহরণ, নির্যাতন, হত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ আনা হয়েছে।

তৃতীয় অভিযোগ: ১৯৭১ সালের ১০ জুলাই রাত ৩টার দিকে আসামি শরীফ আহমেদ, আশরাফ হোসেন, আব্দুল মান্নান, আব্দুল বারী, আবুল হাসেম, শামসুল হক, ইউসুফ আলী ও আল-বদর বাহিনীর সদস্য ও শান্তি কমিটির সদস্যরা জামালপুরের সিঅ্যান্ডবি রোডের (পুরাতন) দয়াময়ী লেনের মল্লিক ভিলা থেকে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন শহীদ নুরুল আমীনকে অপহরণ করে। তারপর ওইদিন সকাল ১০টায় তার মরদেহ ব্রহ্মপুত্র নদের চ্যাপতলা ঘাটে ভেসে ওঠে।

এ ঘটনায় শরীফ হোসেন, মো. আশরাফ হোসেন, মো. আব্দুল মান্নান, মো. আব্দুল বারী, মো. আবুল হাশেম, শামসুল হক, এস এম ইউসুফ আলীর বিরুদ্ধে অপহরণ ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।

চতুর্থ অভিযোগ: জামালপুরে আশরাফ হোসেনের নেতৃত্বে বদর বাহিনী গঠিত হয়, তিনি সে সময় মহকুমাটির ছাত্র সংঘের সভাপতি ছিলেন। জামালপুরের আশেক মাহমুদ ডিগ্রি কলেজকে সে সময় নির্যাতন কেন্দ্র ‘টর্চার সেল’ হিসেবে ব্যবহার করা হত, যার প্রধান ছিলেন আশরাফ হোসেন। আসামি আশরাফ হোসেনের পাশাপাশি আল বদরের সদস্য শরীফ আহমেদও জামায়াতে ইসলামীর প্রভাবশীলী নেতা ছিলেন। আব্দুল মান্নান, আব্দুল বারীসহ অন্যদেরও সেখানে নিয়মিত যাতায়াত ছিল। একাত্তরের ২২ এপ্রিল থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আসামিরা সেখানে অনেককে আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যা করেছে।

এ ঘটনায় শরীফ হোসেন, মো. আশরাফ হোসেন, মো. আব্দুল মান্নান ও মো. আব্দুল বারীর বিরুদ্ধে আটকে রিখে নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।

পঞ্চম অভিযোগ: ১৯৭১ সালের ২২ এপ্রিল থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আসামি শরীফ আহমেদ, আশরাফ হোসেন, আব্দুল মান্নান, আব্দুল বারী, আবুল হাসেম, শামসুল হক ও ইউসুফ আলী এবং স্থানীয় আল বদর বাহিনীর সদস্য ও পাক সেনারা জামালপুরের পিটিআই হোস্টেলকে নির্যাতন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করত। সেখানে হাজারখানেক নিরস্ত্র মানুষকে আটকে রেখে নির্যাতন করা হত এবং রাতে তাদের ব্রহ্মপত্র নদের তীরে শ্মশান ঘাটে নিয়ে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেওয়া হত।

এ ঘটনায় শরীফ হোসেন, মো. আশরাফ হোসেন, মো. আব্দুল মান্নান, মো. আব্দুল বারী, মো. আবুল হাশেম, শামসুল হক, এস এম ইউসুফ আলীর বিরুদ্ধে আটকে রিখে নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email
basic-bank

Be the first to comment on "যুদ্ধাপরাধ: জামালপুরের ৮ আসামির রায়ের অপেক্ষা"

Leave a comment

Your email address will not be published.


*