বিশেষ প্রতিনিধি : আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহেই শুরু হচ্ছে পবিত্র মাহে রমজান। রোজা শুরু হওয়ার জন্য এখন আর মাত্র ১৫-১৭ দিন বাকি মাত্র। এরই মধ্যে একটু একটু করে কৌশলে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে ব্যবসায়ীরা। যদিও সরকার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে রমজানে পর্যাপ্ত পণ্য মজুত আছে দাম বাড়ার কোন সম্ভাবনা নেই। তবে সরকারের সেই ঘোষণার পরেও নানা অযুহাত দেখিয়ে বাড়ছে দাম। আগামীকাল রবিবার পবিত্র শবেবরাত। আর ইতোমধ্যেই দাম বাড়নো হয়েছে চিনি, পেঁয়াজ, রসুন, ডাল ও কাঁচামরিচেরসহ ফার্মের মুরগির। ক্রেতারা বলছেন ইস্যু পেলেই দাম হু হু করে বাড়ে আর বিক্রেতারা শুনালেন অনেক কিছুরই সরবরাহ কম। শুক্রবার ছুটির দিনে রাজধানীর শান্তিনগর, রামপুরা, মালিবাগ, খিলগাঁ, মুগদাপাড়াসহ, বিভিন্ন কাঁচাবাজার ঘুরে ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
শবে-বরাতকে সামনে রেখে দাম বৃদ্ধি পাওয়া অন্যতম হলো চিনি। পবিত্র শবে বরাতে রুটির সাথে হালুয়া খাওয়ার একটি রেওয়াজ আছে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মধ্যে। তবে ব্যবসায়ীরা সেখানে ফায়দা নিচ্ছেন। চিনির চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে
ছয় থেকে আট টাকা বেড়ে গেছে কেজি প্রতি। এ সপ্তাহে প্রতিকেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা, যা গত তিন দিন আগেও ৫২ টাকায় বিক্রি হয়। এয়াড়াও, পেঁয়াজ (দেশি) বিক্রি হচ্ছে ৪২ থেকে ৪৫ টাকা কেজিতে। আর আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ টাকায়। দেশীয় রসুন ১১০ থেকে ১৩০ টাকা এবং বিদেশিগুলো ২১০ থেকে ২৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ছোলা ৮৫ থেকে ৯৫ টাকা। মসুর ডাল (দেশি) মানভেদে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা, (আমদানি) মানভেদে ১০০ থেকে ১৩০ টাকা। মুগ ডাল (মানভেদে) ১০০ থেকে ১২০ টাকা।
এয়াড়াও বাজারে বেড়েছে ফার্মের মুরগির দামও। পাইকারিভাবে দাম বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে এমন কথা শুনালেন খুচরা বিক্রেতারা। তারা আরো বলেন, চাহিদা অনুুযায়ি মুরগি পাইনি। আর বেশি দামে কিনতে হয়েছে তাই একটু বেশি দামে বিক্রি করছি।
এ সপ্তাহে রাজধানীর বাজারে ব্রয়লার প্রতিকেজি ১৭০ থেকে ১৭৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। লেয়ার ২০০ টাকা প্রতিকেজি, আকারভেদে দেশি মুরগি কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৩২০ থেকে ৩৪০ টাকা। পাকিস্তানি মুরগি বিক্রি হচ্ছে প্রতি পিস ২৫০ টাকা থেকে ২৬০ টাকা। এয়াড়াও হঠাৎ করেই রাজধানীর বাজারে বেড়েছে কাঁচামরিচের দর। গত সপ্তাহের ৫০-৫৫ টাকার কাঁচা মরিচ বিক্রি হচ্ছে ৭৫-৮০ টাকা দরে। হঠাৎ করে সপ্তারে মধ্যে ২০ টাকা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিক্রেতারা বলেন, ভারি বর্ষণে নষ্ট হয়ে গেছে কাঁচামরিচের গাছ এমনকি মরেও গেছে। তাই কাঁচামরিচের সরবারহ কমে যাওয়ায় দাম বেড়েছে। তবে ক্রেতারা এমন কথা মানতে নারাজ। ক্রেতারা বলছেন অযুহাত পেলেই হয় দাম বাড়ানোর হিড়িক চলে।
তবে বেশিরভাগ সবজির দাম গত সপ্তাহের চেয়ে প্রায় চার থেকে পাঁচ টাকা বেড়ে গেছে। বাজারে প্রতিকেজি চিচিঙ্গা ৪০ টাকা, ঝিঙ্গা ৪০ টাকা, ঢেড়স ৪০ টাকা, করলা ৪০ টাকা, কাকরোল ৫০ টাকা, ধুন্দল ৪০ টাকা, বেগুন ৫০ টাকা, শশা ৪০ টাকা, বরবটি ৪০ টাকা, কচুর লতি ৫০ টাকা, কচুর মুখি ৮০ টাকা, টমেটো ৪০-৪৫ টাকা কাঁচা আম ৪০ টাকা, বিক্রি হচ্ছে। তবে চলতি সপ্তাহে তেমন হেরফের হয়নি মাছের বাজার। বেশিরভাগ মাছই আগের দামে বিক্রি হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে শান্তিনগর কাঁচাবাজারের বিক্রেতা বলেন, শুক্রবার বাজারে চাহিদা অন্য দিনের চেয়ে বেশি থাকে। আর এদিন মাল (পণ্য) তেমন থাকেনা। তাই দাম বাড়ে। এছাড়াও বাজারে ভোজ্য তেলের মধ্যে খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটারে ৯০ টাকা, সুপার ৭৫ টাকা, প্রতি ৫ লিটার রূঁপচাদা ৪৭০ টাকা ও তীর ৪৫০ টাকা এবং সরিষার তেল মান ভেদে প্রতি কেজি ১২০ টাকা থেকে ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ফার্মের ডিম প্রতি হালি ৩৪ টাকা হালি বিক্রি হচ্ছে। হাঁস ৩৮ থেকে ৪০ টাকা ধরে বিক্রি হচ্ছে। ফার্মের মুরগির দাম বাড়লেও গত সপ্তাহের দামেই বিক্রি হচ্ছে গরু ও খাসির মাংস।
এদিকে রমজানে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে না এমন বক্তব্য দেওয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। প্রতি বছরের মতো এবারও রমজান উপলক্ষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পূর্ব প্রস্তুতি নিয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির মধ্যে গত (০৮ মে) একটি বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেই বৈঠক শেষে কমিটির সভাপতি মো. তাজুল ইসলাম চোধুরী শুনিয়েছিলেন আশার কথা। তিনি বলেছিলেন, এবারের রমজানে নিত্য পণ্যেও দাম বাড়বে না। এসময় বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদও ছিলেন। সভাপতি বলেছিলেন, এবার যথেষ্ট পরিমাণ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য মজুদ রয়েছে। তাই দাম বাড়ার কোনো সুযোগ নেই। তাছাড়া আমাদের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি টিম প্রতিদিন বাজার মনিটরিং করবে।
এয়াড়াও আশার বাণি শুনিয়ে রেখেছেন ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারাও। গত ১৭ মে মঙ্গলবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে এক বৈঠককালে তারা আশ্বস্থের কথা জানান। দেশে বর্তমানে চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি পরিমানে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রীর মজুত রয়েছে। ফলে সংগত কারণেই পণ্যের মূল্য বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে আশ্বাস দিয়ে রেখেছেন ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা। ঐ সভায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাপক পর্যালোচনা করা হয়। সভায় নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের উৎপাদনকারী, আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা অংশ নেন। ঐ সভা শেষেও বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, পরিত্র রমজান মাসকে সামনে রেখে চাল, আটা, চিনি, ভোজ্য তেল, ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ ও খেজুরসহ সকল পণ্যের সরবাহ ও মজুত নিশ্চিত করা হয়েছে। কোন অবস্থাতেই যাতে কোনো পণ্যের দাম অযৌক্তিক বৃদ্ধি না পায় সে জন্য সরকার সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
মন্ত্রী ঐ সময় জানান, দেশে বছরে ভোজ্য তেলের চাহিদা ১৫ লাখ মেট্রিকটন। অথচ এপ্রিল, ২০১৬ নাগাদ আমদানি হয়েছে ১৮.৯০ লাখ মেট্রিকটন। অর্থাৎ চাহিদার চেয়ে প্রায় ৩ লাখ ৯০ হাজার বেশি মেট্রিকটন তেল উৎপাদন হয়েছে।
একইভাবে চিনির বার্ষিক চাহিদা ১৪ থেকে ১৫ লাখ মেট্রিকটন। এপ্রিল, ২০১৬ পর্যন্ত পণ্যটি আমদানি হয়েছে ১২.৭৪ লাখ মেট্রিকটন এবং দেশীয় উৎপাদন ১.২০ লাখ মেট্রিকটন। এছাড়া গত বছর চিনি আমদানি হয়েছে ১৭.৯৪ লাখ মেট্রিকটন। সবমিলিয়ে দেশের চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি চিনি মজুদ রয়েছে। ফলে কোনো পণ্যের দাম বাড়বে না। অথচ এরই মধ্যে বেড়ে গেছে চিনির দাম।
এদিকে, পবিত্র রমজান উপলক্ষে সারা দেশের ১৭৪টি পয়েন্টে টিসিবি ট্রাক বসাবে। যেখানে চিনি, মসুর ডাল, ছোলা, সয়াবিন তেল ও খেজুর সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি হবে।
মন্ত্রণালয়ের অনেক উদ্যেগের পরেও বিভিন্ন ইস্যু আর আড়ালের অসাধু ব্যবসায়িদের কারণে বেড়ে যাচ্ছে দাম। যা নিয়ে চিন্তায় আর ভোগান্তিতে আছে সাধারণ মানুষ। ক্রেতারা মনে করছেন শবেবরাতের আগেই যে হারে দাম বাড়ানো হচ্ছে তাহলে রমজানে কি হবে। রোজায় কি দাম বাড়বে না অপরিবর্তিত থাকবে বাজার? এই প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছে এখন সবার কাছে। তবে অনেকেই মনে করছেন মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেলের কাজটা যেন আরো একটু বৃদ্দি করা হয় এবং সর্বদা নজরদারীতে রাখা হয়। তাহলে হয়তো অনেক অসাধু ব্যবসায়িদের ফাঁদ থেকে কিছু সুবিধা পাবেন ক্রেতারাও।

Be the first to comment on "কৌশলে শবেবরাতেই কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে, রোজায় কি হবে?"