সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
ড. আতিউর যা পারেননি, পারবেন কী ফজলে কবীর? অর্থমন্ত্রীও কী পারবেন আগের চেয়ে বেশি সক্রিয়তা দেখাতে? বড় প্রশ্ন আজ জাতির সামনে। বাংলাদেশের ব্যাংকিং তথা আর্থিক খাতে এমন অবিশ্বাস্য খারাপ আবহাওয়া আর কোনোদিন আসেনি। ঝোড়ো এই আবহাওয়ায় কী হবে, সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। এখানে কোনো এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল নেই যারা পথ দেখাতে পারে। বরং সবাই যেন দিশেহারা।
এই যখন বাস্তবতা তখন রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনায় বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায়। নতুন গভর্নর নিয়োগের পাশাপাশি অব্যাহতি দেয়া হয়েছে দুই ডেপুটি গভর্নরকে। পরিবর্তন এসেছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব পদেও। নতুন গভর্নর যোগ দেয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আরো পরিবর্তন আসবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
সৎ মানুষের বিদায় মানুষকে কষ্ট দেয়। কিন্তু প্রশাসনিক ব্যর্থতা থাকলে তার পতন কেউ আটকাতে পারে না। ড. আতিউর বা বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য শুধু নয়, দেশের জন্যই এক কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবশ সৃষ্টি করেছে এই ঘটনা। তাই এখন পক্ষবিপক্ষ বাদ দিয়ে অর্থমন্ত্রীর লক্ষ্য হবে ঘটনা কেমন করে ঘটলো, কারা ঘটালো, কেন ঘটালো তা বের করা। বিদেশি চোর বা হ্যাকারদের সঙ্গে স্থানীয় কেউ ছিল কি না, তা খুঁজে বের করা। সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে তদন্তের ওপর। সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের মাধ্যমেই তো জানা যাবে কোথায় কোথায় ঘাটতি ছিল। ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনকে নিয়ে যে তদন্ত কমিটি হয়েছে, আশা করছি সেই কমিটি সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরপেক্ষ সহযোগিতা পাবে।
বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি খাত দ্রুত বিকাশমান। যা কিছু দ্রুত এগোয় তাতে ফাঁকও থাকে। এই খাতটি প্রসারের পাশাপাশি যে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি করার কথা ছিল, তা করা হয়নি। আর সবচেয়ে বড় সমস্যা মানসিকতার। আমাদের উচ্চ পর্যায়ের মানুষজন তথ্য প্রযুক্তির সব বিষয়ে সবসময় নির্ভর করে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের উপর। অথচ আমরা জানি আমাদের দেশের কতজন এ বিষয়ে কতটা এগিয়ে আছেন, আমরা তাদের খুঁজে পাইনা। তদন্ত ও ব্যাংকের লেনদেনের নিরাপত্তায় দেশীয় বিশেষজ্ঞের কোনো বিকল্প আছে কী?
আর একটি বিষয় হলো মনোজগতে যদি চৌর্যবৃত্তিকে সমর্থন করা হয় তাতেও সমাধান আসে না। আজ ৮০০ কোটি টাকা নিয়ে অনেক কথাই বলা হচ্ছে। অর্থমন্ত্রীকে অনেক রাগান্বিতও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এই তিনিই হল মার্কের মাধ্যমে চার হাজার কোটি টাকা লোপাটের ঘটনায় বলেছিলেন ‘এটা কিছুই না’। বেসিক ব্যাংকে যখন ঋণ কেলেঙ্কারি ঘটলো, তখনো এর যে মূল হোতা শেখ আবদুল হাই বাচ্চু তাকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সহযোগিতা দিয়ে গেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সে সময় ব্যবস্থা নিলে হয়তো দেশি-বিদেশি তস্করেরা ভয় পেত এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে হাত দেওয়ার সাহস পেত না। এখন একটিই কাজ ভাবাবেগকে দূরে রেখে বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ চুরির ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করা এবং এই দুষ্কর্মের হোতাদের ধরে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের টাকা এভাবে খোয়া যাওয়া একটি দুঃখজনক ঘটনাই নয়, বড় কেলেংকারিও বটে। উদ্বেগ আরো বেশি, কারণ দেশি-বিদেশি চোরের দলের কাছে চলে গেছে বাংলাদেশের আর্থিক খাতের সব তথ্য। আজ দেশের আর্থিক খাতের নিরাপত্তা বড় ঝুঁকির মুখে। একটি বড় প্রশ্ন- টাকা খোয়া গেল অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক সময়মতো সরকারকে তা জানালো না, কেন? কেন এই লুকোচুরি, কেন এই অনীহা? গভর্নর এমন একটি ঘটনা তার প্রতিষ্ঠানে এমন একটা ঘটনা ঘটার পর ঠাণ্ডা মাথায় বাংলা একাডেমির পদক নিতে পারলেন? ভারতে চারদিন অবস্থান করে সেমিনার করতে পারলেন?
টাকার হিসাবে এই অঙ্ক খুব একটা বড় নয়। কিন্তু এর ফলে বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি সংকটে পড়বে। বাইরের মানুষ এটাকে আমাদের দক্ষতা ও সুশাসনের অভাব হিসেবেই চিহ্নিত করবে। তাই এ ঘটনাকে দেখতে হবে বড় সুযোগ হিসেবেও। যেখানে যেটুকু ফাঁক আছে তা চিহ্নিত করা জরুরি। ঘটনা কেবল বাংলাদেশ ব্যাংকে ঘটেছে তাতো নয়, এটিএম বুথে স্কিমিং মেশিন বসিয়ে কার্ড ক্লোন করে অনেক গ্রাহকের টাকা জালিয়াতি করে তুলে নেওয়া হয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ আমানতকারীরাও আমানতের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে পারেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যাবলি কী হবে, বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার ১৯৭২-এ তা স্পষ্ট করা আছে। ছয়টি প্রধান কার্যাবলির মধ্যে চতুর্থটি হলো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখা ও ব্যবস্থাপনা। অন্য কার্যাবলির মধ্যে রয়েছে মুদ্রানীতি ও বাস্তবায়ন, বৈদেশিক ব্যবসায় নীতি প্রণয়ন, মুদ্রানীতি বাস্তবায়নে সরকারকে পরামর্শ প্রদান, নিরাপদ পেমেন্ট সিস্টেম ও মুদ্রা ব্যবস্থাপনা এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য বিধি-বিধান প্রণয়ন ও তদারক করা। কিন্তু আমরা দেখেছি বাংলাদেশ ব্যাংক তার মৌলিক কাজের বাইরে, বিশেষ করে সদ্য বিদায়ী গভর্নর অন্যান্য কাজে বেশি মনোযোগী হয়ে পড়েছিলেন। এর প্রভাব পড়েছে ব্যাংকের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে। রিজার্ভ চুরির ঘটনা সরাসরি ব্যবস্থাপনার ত্রুটি বা ব্যর্থতা। তথ্যমতে, ২০১৪-১৫ অর্থবছর বাংলাদেশ ব্যাংকের নিট লোকসান দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬২২ কোটি টাকা। এ সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা থেকে লোকসান হয়েছে ৪ হাজার ১৫১ কোটি টাকা। স্বর্ণের দাম কমে যাওয়া ও বিভিন্ন দেশের মুদ্রার মান কমে যাওয়ার পাশাপাশি ব্যবস্থাপনা দুর্বলতায় এমনটি হয়েছে বলা যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মসংস্কৃতি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ড. আতিউরের বিদায়ী ভাষণেও তা স্পষ্ট হয়েছে। হ্যাকিং হচ্ছে জানতে পেরে নিউ ইয়র্ক থেকে নিজার্ভ ব্যাংক বারবার যোগাযোগ করেও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাউকে পায়নি। ড. আতিউর বলছেন শুক্রবার থাকায় যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। এটি মেনে নেয়া যায়? এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর স্থানে কি শুক্র বা শনিবার বলে কিছু থাকতে পারে? আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ফরেক্স ট্রেডিং হয় শুধু অফিস সময়ে। এ সময় বিশ্বের বড় দেশগুলোর ট্রেড বন্ধ থাকে। এই কর্মসংস্কৃতির পরিবর্তন প্রয়োজন। সবসময় পাহারাদার কেন থাকবে না এই জবাব দিতে হবে কর্তৃপক্ষকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুপারভিশন বিভাগের কর্মকর্তাদের সততা ও দক্ষতা আমরা প্রত্যাশা করি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সুপারভিশন বিভাগের সংস্কার অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় এ বিভাগের পরিদর্শক থেকে ডেপুটি গভর্নর পর্যন্ত প্রত্যেক কর্মকর্তাকে সন্দেহাতীতভাবে সৎ, সাহসী ও দক্ষ হতে হবে।
সন্দেহ নেই খারাপ সময় যাচ্ছে আমাদের আর্থিক খাতে। পরিস্থিতি উন্নয়নে সংস্কার প্রয়োজন। চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময় অর্থমন্ত্রী দেশের আর্থিক খাতের অবস্থা বিবেচনায় ব্যাংকিং সংস্কার কমিশন গঠনের কথা বলেছিলেন। অর্থবছরের আট মাস শেষ হলেও এ-সংক্রান্ত কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। হল-মার্ক ও বিসমিল্লাহ গ্রুপ কেলেঙ্কারি এবং বেসিক ব্যাংকে দুর্নীতির মাধ্যমে শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকেই হাতিয়ে নেয়া হয়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। অর্থ লোপাটের কারণে আর্থিক সংকটে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। এসবের দায় এককভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নয়। বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকে যেসব ঘটনা ঘটেছে তার সিংহভাগ দায়িত্ব অর্থমন্ত্রীর, কারণ তার অধীনস্ত ব্যাংকিং বিভাগ এখানে মূল নিয়ন্ত্রক। আশা করি এখন থেকে অর্থমন্ত্রী রেগে রেগে সবাইকে ধমক দেওয়ার সময় নিজের প্রতিও নজর দিবেন। তিনি কি করেছেন, করছেন আর করতে পেরেছেন, আশা করি জবাব দিবেন। নিরপেক্ষভাবে আর্থিক ব্যবস্থাপনা পরিচালনায় তার ব্যর্থতা যে সর্বত্র আলোচিত হয়, আশা করি কান পেতে শুনবেন সেটাও।
সূত্র: জােগা নিউজ
Be the first to comment on "নিজের প্রতিও নজর দিন অর্থমন্ত্রী"