রাশেদ জামান, লোহাগড়া (নড়াইল) প্রতিনিধি ॥ দৈনিক মানবজমিন ও গ্রামের কাগজ পত্রিকার লোহাগড়া প্রতিনিধি ও লোহাগড়া প্রেসক্লাবের যুগ্ন সাধারন সম্পাদক সাংবাদিক শাহজাহান সাজুকে ‘ষড়যন্ত্রমূলকভাবে’ হত্যা মামলায় আসামি করার নেপথ্যে রয়েছেন কাশিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান। তার দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের কারনে তিনি মামলার বাদীকে ম্যানেজ করে সাংবাদিক শাহজাহান সাজুকে ওই মামলায় আসামি করিয়েছেন।
যার বিরুদ্ধে স্থানীয় সাংবাদিক সমাজসহ রাজনৈতিক,সামাজিক,সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। সাজু’র বিরুদ্ধে মামলার সূত্র ধরে এর নেপথ্যের কারন অনুসন্ধান করতে যেয়ে বেরিয়ে আসে চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমানের দুর্নীতির নানা কাহিনী। একের পর এক দুর্নীতিতে জড়িয়ে ইতোমধ্যেই মতিয়ার রহমান একাধিক মামলার আসামি হয়েছেন। আর সেসব সংবাদ গ্রামের কাগজে প্রকাশের কারনে চেয়ারম্যান সাংবাদিক সাজু’র ওপর ক্ষিপ্ত হয়েছেন। এর আগে একবার সাজু’র হাত-পা কেটে দেয়াসহ তাকে হত্যারও হুমকি দিয়েছিলেন তিনি। যে কারনে জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে সাজু লোহাগড়া থানায় সাধারন ডায়েরিও করেছিলেন। কাশিপুর ইউনিয়নের মহাদুর্নীতিবাজ চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমানের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালের ১লা ফেব্রুয়ারী গ্রামের কাগজে “লোহাগড়ায় এলজিএসপি প্রকল্পের দুর্নীতির তদন্তে দুদক” শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ২০১৫-১৬ অর্থ বছরের এলজিএসপির পাঁচটি প্রকল্পের বিপুল পরিমান অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় ওই সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছিল। পরে দুদকের যশোর কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো: শহীদুল ইসলাম তদন্ত করে ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় ২০১৭ সালের ৩০ মে লোহাগড়া থানায় চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমানসহ তার চার সহযোগীর বিরুদ্ধে ৫টি মামলা দায়ের করেন।
২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঈদুল আযহা উপলক্ষে কাশিপুর ইউনিয়নের হৃতদরিদ্রদের জন্য ২৭ হাজার ৬শ’ কেজি (৫০ কেজি বস্তার ৫৫২ বস্তা) ভিজিএফ’র চাল বরাদ্ধ হয়। চেয়ারম্যান চাল উত্তোলন করে ২৫২ বস্তা লোহাগড়া খাদ্য গুদামের গেট থেকেই বিক্রি করে দেন। বিষয়টি নিয়ে ওই বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর “লোহাগড়ায় ভিজিএফ এর ২৫২ বস্তা চাল আত্মসাত” শিরোনামে গ্রামের কাগজে এবং ২০ সেপ্টেম্বর মানবজমিন এ “লোহাগড়ায় ১০ কোটি টাকার জিআর প্রকল্পের চাল আত্মসাত” শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এর ভিত্তিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) যশোর সম্মনীত কার্যালয়ের উপ-সহকারী পরিচালক তানভীর আহম্মেদ ২০১৭ সালের ১০ জানুয়ারী সরেজমিন তদন্ত করেন। বিষয়টি এখনো দুদক’র তদন্তাধীন রয়েছে। এর পর সাংবাদিক সাজু’র ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন চেয়ারম্যান মতিয়ারসহ তার অস্ত্রধারী ক্যাডার বাহিনী। চেয়ারম্যান মতিয়ার হুঙ্কার দিয়ে পোষ্য সন্ত্রাসীদের বলেছিলেন সাজু যে হাতে নিউজ লিখেছে সেই হাত কেটে তার কাছে দেয়ার জন্যে। পাশাপাশি তিনি সাজুকে হত্যারও হুমকি দিয়েছিলেন এ ঘটনায় শাহজাহান সাজু জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে ২০১৭ সালে ১৩ আগষ্ট লোহাগড়া থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন।
২০১৬ সালে কাশিপুর ইউনিয়নের ৪৩ টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ওয়াজ মাহফিল ও নামযজ্ঞের নামে ৮৬ মেট্রিকটন জিআর প্রকল্পের চাল উত্তোলন করে আত্মসাত করেছিলেন চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান। ওই ঘটনায়“লোহাগড়ায় চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের চাল আত্মসাতের অভিযোগ” শিরোনামে ১০ অক্টোবর গ্রামের কাগজে সংবাদ প্রকাশিত হয়।
২০১৭ সালের ২৮জুন ভিজিএফ’র বরাদ্দকৃত গম চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান বিতরণ না করে বিক্রি করায় প্রতিবাদ করলে ইউপি সদস্য আলমগীর হোসেনকে ছুরিকাঘাত করে মারাত্বক জখম করেন চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান। এ ঘটনায় ওই ইউপি সদস্য খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন। চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরে চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমানকে প্রধান আসামী করে ৮ জুলাই লোহাগড়া থানায় মামলা করেছিলেন। এটা নিয়ে ১০ জুলাই গ্রামের কাগজে সংবাদ প্রকাশ করে “ভিজিএফএর গম চুরির প্রতিবাদ করায় মেম্বরকে ছুরিকাঘাত, লোহাগড়ায় চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মামলা” শিরোনামে।
২০১৯ সালে ৯ আগষ্ট দু’টি নছিমনসহ ভিজিএফ’র ১২০ বস্তা চাল বিক্রির সময় লোহাগড়া থানা পুলিশ হাতে নাতে আটক করে। ওই চাল কালোবাজারে বিক্রি করছিলেন চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান। পরে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) এসএমএ করিম বাদী হয়ে চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমানকে আসামী করে ১১আগষ্ট লোহাগড়া থানায় মামলা দায়ের করেন। এটি নিয়ে সংবাদ হয় “লোহাগড়ায় ভিজিএফ’র চাল কালোবাজারে বিক্রি” শিরোনামে। মামলাটি দুদক তদন্ত করছে। দুদক ইতোমধ্যে ৫০ কেজির প্রতি বস্তায় ১২০ বস্তা চাল নিলামে বিক্রি করে সমুদয় অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করেছে। চাল না পাওয়া ২৪০টি হৃতদরিদ্র পরিবার চালের দাবীতে গত বছরের ৩১ আগষ্ট এড়েন্দা বাজারে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। ওই ঘটনায় ১ সেপ্টেম্বর গ্রামের কাগজের সংবাদের শিরোনাম ছিলো “বঞ্চিত ১২০ পরিবারকে চাল প্রদানের দাবীতে সংবাদ সম্মেলন, লোহাগড়ায় ভিজিএফ’র চাল কালোবাজারে বিক্রি”।
সর্বশেষ গত মাসে কাশিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বরের বিরুদ্ধে ৫৭টি ভিজিডি কার্ডের বিপরীতে ২৪ মেট্রিকটন ভিজিডির চাল বিভিন্ন ভুয়া নামে তুলে আত্মসাতের অভিযোগ উত্থাপিত হয়। “লোহাগড়ার কাশিপুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও মেম্বরের বিরুদ্ধে ভিজিডির চাল আত্মসাতের অভিযোগ” শিরোনামে ৭মে গ্রামের কাগজ সংবাদ প্রকাশ করে। সংবাদের সুত্র ধরে কাশিপুর ইউনিয়নবাসির পক্ষে ওই ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বর আব্দুল অহেদ শেখ বাদী হয়ে প্রধানমন্ত্রীসহ অন্তত ২৫ টি দপ্তরে “করোনাকালে নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার ১২ নং কাশিপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও মেম্বর কতৃক ভিজিডি কার্ডের ২৪ মেট্রিকটন চাল আত্মসাত উল্লেখ করে লিখিত অভিযোগ করেন। কাশিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমানের এসব দুর্নীতির বিরুদ্ধে গ্রামের কাগজে সংবাদ প্রকাশের কারনে সাংবাদিক সাজু’র বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন মতিয়ার রহমান। তিনি বিভিন্ন সময় সাজুকে সত্য প্রকাশে নিবৃত করতে সন্ত্রাসী বাহিনী লেলিয়ে দেয়া ছাড়াও নিজে হুমকি দিয়েছেন। অন্যায়ভাবেও সাংবাদিকের কলম রুখতে না পেরে এবার ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেছেন তিনি।
গত ১০ জুন কাশিপুর ইউনিয়নের গন্ডব গ্রামে সংঘর্ষে নিহত রফিকুল ইসলামের পিতা চেয়ারম্যানের একান্ত অনুগত। সে সুযোগে তিনি রফিকুলের হত্যা মামলায় বাদী তার পিতাকে দিয়ে সাংবাদিক সাজু’র নাম অর্ন্তভূক্ত করিয়েছেন। অথচ, সাজু’র বাড়ি লোহাগড়া পৌরসভায়। ঘটনাস্থল থেকে যার দূরত্ব প্রায় ১২ কিলোমিটার। তাছাড়া, ওই সংঘর্ষের সংবাদ পরের দিন দৈনিক গ্রামের কাগজেও প্রকাশিত হয়েছিল। লোহাগড়া থানা সূত্রে জানা গেছে, নিহত রফিকুল ৪টি হত্যাসহ ধর্ষন, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই ও অস্ত্র মামলাসহ অন্তত এক ডজন মামলার আসামী ছিলেন। তার বিরুদ্ধে চলতি বছরের ২৫ মার্চ গ্রামের কাগজ সংবাদ প্রকাশ করে “লোহাগড়ায় অস্ত্রসহ দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী রফিক আটক” শিরোনামে। বিরোধপূর্ণ পার চালিঘাট এলাকা থেকে গভীর রাতে তিনটি দেশীয় অস্ত্রসহ লোহাগড়া থানার এসআই মাহফুজুল হক তাকে আটক করে জেল হাজতে প্রেরন করে।
Be the first to comment on "লোহাগড়ায় দুর্নীতিবাজ ইউপি চেয়ারম্যান মতিয়ারের বিরুদ্ধে সংবাদ লিখেই ষড়যন্ত্রের শিকার সাংবাদিক সাজু!"