বিশেষ প্রতিবেদক: পুরোনো ঢাকার লালবাগের বাসিন্দা গৃহবধূ রিপা বেগম। শুক্রবার সন্ধ্যায় কলেজ পড়ুয়া মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে কিছু প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে নিউমার্কেটে যান। কেনাকাটা শেষে উত্তরদিকের গেট দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে গেট বরাবর ফুটপাতের একটি দোকানের দিকে এগিয়ে গেলেন।
সেই দোকানটিতে থরে থরে সাজানো ইসলামি বিভিন্ন বই পুস্তক। রিপা বেগম দোকানদারের কাছে নেয়ামুল কোরআন চাইতেই লোকটি থরে থরে সাজানো বইগুলো দুই হাতে হাতরাতে লাগলেন। সেকেন্ড ত্রিশেক পর মাঝের সারি থেকে নেয়ামুল কোরআন বের করে ভদ্রমহিলার হাতে দিলেন।
বইটি হাতে নিয়ে মেয়েকে চোখের ইশারায় কিছু বললেন। এবার মেয়েটি দোকানদারের কাছে নামাজ শিক্ষা আছে কিনা জানতে চাইলে পেছন দিকে ঘুরে হাতরে নামাজ শিক্ষা বের করে দিলেন।
বইয়ের দাম মিটিয়ে চলে যাওয়ার সময় মা ও মেয়ে উভয়ই বিক্রেতার কাছে জানতে চাইলেন, বুড়া মিয়া, আপনিতো চোখে দেখেন না, এত তাড়াতাড়ি বই খুঁজে কিভাবে বের করে দিলেন।
প্রশ্নোত্তরে দোকানদার বললেন, আল্লাহই বই খুঁজে পেতে সাহায্য করেন তাই সমস্যা হয় না।
অন্ধ এই দোকানদারের নাম আমিনউদ্দিন। শরীয়তপুর জেলার পালং থানার চন্দ্রপুর গ্রামের বাসিন্দা আমিনউদ্দিন গত চার দশকের বেশি সময় যাবত অন্ধ। গত তিন দশক যাবত নিউমার্কেট এলাকার ফুটপাতে ইসলামি বইয়ের ব্যবসা করছেন। অন্ধ হলেও নাম বলা মাত্রই তিনি অনায়াসে যে কোন বই খুঁজে বের করে দেন।
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে আমিনউদ্দিন জানান, ১৪ বছর বয়সে গুটিবসন্ত হলে তার দুচোখ অন্ধ হয়ে যায়। বাবার হাত ধরে ঢাকায় নিউমার্কেট এলাকায় এসে ইসলামি বইয়ের ব্যবসায় নেমে পড়েন। বাংলাবাজার ও চকবাজার থেকে বিভিন্ন ইসলামি বই পুস্তক কিনে এনে বিক্রি শুরু করেন। সেই যে ব্যবসা শুরু করেছিলেন তারপর থেকে কখনও তিনি বেকার বসে কাটাননি।
তার কাছে কি কি বই আছে জানতে চাইলে এক নিঃশ্বাসে বলতে থাকলেন কোরআন শরিফ, বোখারি শরিফ, নেয়ামুল কোরআন, নামাজ শিক্ষা, নবীজীদের জীবন, বেহেশতের কুনজি ও স্ত্রী শিক্ষা, জান্নাতের সীমাহীন নিয়ামত, জাহান্নামের ভয়াবহ আযাব, তাবিজনামা, খোয়াবের কেতাব, ইসলামের ফরজ বিধান পর্দা, কাফন-দাফন কবরের জীবন, জীন ও ফেরেশতাদের জীবন, অজিফাতুল আওলিয়া, নুরাণি পূর্ণাঙ্গ অজিফা শরিফ ও সুফি তত্ত্ব, মারফতের গোপন তত্ত্ব ইত্যাদি।
আমিনউদ্দিন জানান, দোকানের কোন বইটি কোন সারিতে আছে তা তার প্রায় মুখস্ত। ক্রেতারা বলামাত্রই তিনি বের করে দিতে পারেন। টাকাপয়সা হাতের স্পর্শে অনুভব করে গুনে নেন। ইসলামি বইয়ের ব্যবসা করার কারণ চাইলে বলেন, এক সময় গল্প-উপন্যাসের বই বিক্রি করতেন। কিন্তু সেই সব বইপুস্তক চুরি হয়ে যেতো। অন্ধ হওয়ায় চোরকে ধরতেও পারতেন না। পরে চুরি বন্ধ করতে বুদ্ধি বের করে ইসলামি বই বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন।
আমিনউদ্দিন জানান, মানুষ আল্লাহ তা’আলারে ভয় পায়। তাই ইসলামি বই চুরি করে না।
অন্ধ আমিনউদ্দিনের দুই ছেলে এক মেয়ে। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলেকেও বিয়ে দিয়েছেন। দুই নাতি-নাতনিও আছে তার। তিনি জানান, ‘বড় পোলা কামলা খেটে খায়, যে টাকা রোজগার করে তা দিয়ে চলতে পারে না তাই দেশে টাকা পাঠাইতে হয়।’
দৈনিক কত টাকার বই বিক্রি হয় জানতে চাইলে আমিনউদ্দিন বলেন, ব্যবসা খুব একটা ভাল না। হাজার দুয়েক টাকার বইও বিক্রি হয় না। তবে রোজার মাসে বিক্রি ভাল হয় বলে জানান তিনি।
Be the first to comment on "৪০ বছরের অন্ধজীবনে বেকার বসে কাটাননি আমিনউদ্দিন"