ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ
তিলতিল করে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। আর চাইলে এক লহমায় একে ধ্বংস করে ফেলা যায়। মুক্তিযুদ্ধ ৪৪ বছর পার করে ফেলেছে। স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম ভিত্তি ছিল গণতন্ত্র। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্খা বুকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাঙালি। দেশের অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন কিন্তু আমরা দেশকে প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্র দিতে পারিনি। এদেশের রাজনীতিকদের বড় ব্যর্থতা এখানেই। আমাদের রাজনীতিকরা ক্ষমতার বলয়ের ভেতর কেবল ঘুরপাক খাচ্ছেন। কোনো রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে গণতন্ত্র বিপন্ন হওয়ার প্রধান দায় প্রধানত রাজনীতিকদেরই। দলীয় নীতি নির্ধারণ এবং গণতন্ত্র রক্ষার জন্য নির্মোহভাবে দায়িত্বশীলতার সাথে কাজ না করতে পারলে গণতন্ত্রের কর্ষণ হবে কেমন করে। কিন্তু স্বাধীনতা উত্তরকাল থেকে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কোনো রাজনৈতিক দলই সততা নিয়ে কাজ করেনি। অনেক বেশি ক্ষমতা কেন্দ্রিকতা গণতন্ত্রের যাত্রা পথকে দুর্বল করে দিয়েছে।
গণতন্ত্রের সহজ পাঠ বলে থাকে জনগণের অধিকার সুরক্ষা গণতন্ত্রের প্রধান লক্ষণ। কিন্তু আমাদের ক্ষমতার দৌড়ে থাকা দলগুলো গণতন্ত্রকে দলতন্ত্রে আটকে ফেলেছে। দলীয় বলয়ের বাইরে মানুষের কাছে পৌঁছতে চায়নি কেউ। ফলে আমাদের রাজনৈতিক কর্মভূমিকায় জনগণকে তেমনভাবে যুক্ত করা যায়নি। এদেশে গণতন্ত্রের বিবর্ণ দশা এখান থেকেই।
রাজাসন পাওয়ার জন্য রাজনীতিকগণ যতটা ঘর্মাক্ত থাকেন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ততটা ভক্তির প্রকাশ নেই তাঁদের আচরণে। তাঁদের মনোযোগ দলতন্ত্রের অচলায়তন তৈরি করে কার্যত গণতন্ত্রকে নির্বাসন দেয়া। তাই এখন এদেশে বক্তৃতার মঞ্চে এবং টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে আমাদের রাজনীতি অঞ্চলের নেতা নেত্রীরা শুধু গণতন্ত্র শব্দটির চর্চা করছেন। কেবল নির্বাচন ব্যবস্থার মধ্যে গণতন্ত্রের কিছুটা লক্ষণ টিকে থাকলেও এর নিরপেক্ষ ব্যবহারের অভাবে এখন তাও প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে।
এদেশের নির্বাচনী গণতন্ত্রের অপেক্ষাকৃত শুদ্ধ ধারাটি অনেকটা টিকেছিল তৃণমূলে ইউনিয়ন কাউন্সিল নির্বাচনে। এবার বোধহর এর ভিত্তিও নড়বড়ে হয়ে গেল। এই অঘটনটির মূল সম্ভবত দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করা। আগে দলীয় বৃত্তে বন্দি না থেকেও অনেক জনপ্রিয় মানুষ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে দাঁড়াতেন এবং নির্বাচিতও হতেন। নিজ এলাকার জনগণের সাথে আত্মিক সম্পর্ক থাকায় এলাকার উন্নয়নে তাঁরা নির্মোহভাবে কাজ করতেন। এই সব নির্বাচন হতো অনেক বেশি আনন্দঘন। সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততা থাকতো। আর এর মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র চর্চা একটি দৃঢ় ভিত্তি পেয়ে যেতো।
এভাবে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনটি একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠেছিল। কিন্তু বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে এখন মনে হচ্ছে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করতে গিয়ে এই প্রতিষ্ঠানটিকে দুমড়ে মুচরে দেয়া হলো। রাজনৈতিক দলগুলো যে পরিমাণ ব্লেম গেইমে মত্ত থাকে এর সিকি ভাগ দায়িত্বশীলতা যদি নির্বাচন প্রক্রিয়াকে সাধ্যমত পরিশুদ্ধ করায় দেখাতে পারতো তবে ধীরে ধীরে গণতন্ত্র ঔজ্জ্বল্য ফিরে পেতে পারতো।
আমি বলবো এবার ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অপেক্ষাকৃত ইতিবাচক ধারা তৈরি করেছে। দলীয় প্রতীকে করা না কারার মধ্যে ভিন্ন তাৎপর্য বহন করে না। পরোক্ষভাবে হলেও নির্বাচন তো হয় দলীয়ভাবেই। যেহেতু আমাদের দেশের বাস্তবতায় গণতন্ত্রের প্রতীকী ধারা হিসেবে এখনো নির্বাচন টিকে আছে। তাই নির্বাচনের পথ ধরেই গণতন্ত্রে ফিরে যেতে হবে। আর সেকারণে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বার্থে নির্বাচনকে যতটা সম্ভব শুদ্ধ করার চেষ্টা নেয়া উচিত সকল পক্ষের।
আমরা মনে করি তৃণমূলের এই নির্বাচন গণতন্ত্রের ভিত রচনা করতে পারে সহজেই। আইউব খান নিজ ক্ষমতার ক্ষেত্র শক্ত করার জন্য মৌলিক গণতন্ত্র বলে এক অদ্ভুত গণতন্ত্র জারি করেছিলেন। তিনিও মনে করেছিলেন ভিত শক্ত করতে তৃণমূল থেকেই অগ্রসর হতে হবে। তাই ইউনিয়ন কাউন্সিলকে ইউনিয়ন বোর্ডে রূপান্তর করে চেয়ারম্যানের বদলে ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করিয়ে কাঠামোতে একটি বড় রূপান্তর করেন। আইউব খান না হয় নিজের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য মৌলিক গণতন্ত্রী তৈরি করেছিলেন কিন্তু গ্রামীণ জীবন কাঠামো বিকাশে ইউনিয়ন বোর্ডের ভূমিকা কম ছিল না।
আমরাও মনে করি অনেক সীমাবদ্ধতার ভেতরে থেকেও গণতন্ত্রের স্বার্থে সকল পক্ষের সক্রিয় থেকে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনকে সফল করে তোলা উচিত। কিন্তু দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করতে গিয়ে যে বাস্তবতা তৈরি হয়েছে এর জটিলতা থেকে বের করে আনা কঠিন হবে। তারপরেও হয়তো সামাল দেয়া সম্ভব হতো যদি দলগুলো শতভাগ নিরপেক্ষ ও দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা নিঃস্বার্থ থেকে তৃণমূলের প্রার্থী নির্বাচনকে প্রাধান্য দিতেন এবং নির্বাচন কমিশন নিজ মেরুদণ্ডে দাঁড়িয়ে একটি সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন উপহার দিতে পারতেন। কিন্তু বাস্তবতা কী বলছে!
এর মধ্যে বেশ কিছু অভিযোগ উঠে এসেছে। যেমন সরকারী দলের চাপে অনেক বিএনপি প্রার্থী নাকি মনোনয়ন পত্র জমা দিতে পারেননি। আমরা মনে করি এমনটি হলে সুনির্দিষ্টভাবে আইনি প্রক্রিয়ায় অভিযোগ উত্থাপিত হওয়া উচিত। এর সত্যাসত্য যাচাই করে নির্বাচন কমিশনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। অনেক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর অভাবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সরকার দলীয় প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়ে গেছেন। বর্তমান সময়ে বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা প্রকট। এই বাস্তবতায় সকল ক্ষেত্রে যোগ্যতা পূরণ করা প্রার্থী কোনো কোনো ইউনিয়নে না পাওয়া যেতেই পারে। তবে এই সংখ্যা বেশি হলে সন্দেহের অবকাশ থাকে।
মনে রাখতে হবে নির্বাচন ব্যবস্থার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্পর্কটি ঘনিষ্ট। প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন গণতান্ত্রিক শক্তিকে দুর্বল করে দেবে। সরকার পক্ষেরই উচিত হবে নিজ উদ্যোগে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্র তৈরি করা। ২০১৪-এর ৫ জানুয়ারির নির্বাচন এবং অতঃপর পৌরসভা নির্বাচন নিয়ে যেসব অস্বস্তি অসন্তোষ রয়েছে তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সরকার পক্ষের সামনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন। বাস্তব ধারণা থেকে বলা যায় বর্তমানে জামায়াত ও বিএনপি এদের অতীত কর্মকাণ্ডের কারণেই জনপ্রিয়তার সূচকে নিচের দিকে অবস্থান করছে।
বর্তমান সরকারের উন্নয়ন কর্মপ্রয়াসের সুফল সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ কম বেশি ভোগ করছে। এসময়ে সরকার ও সরকার পক্ষের সৎ ও সরল প্রয়াসকে মানুষ স্বাগত জানাবে। তারপরেও নির্বাচনে অনৈতিক প্রভাব বিস্তারকে মানুষ সহজভাবে নেবে না। এতে একদিকে বিরোধী পক্ষের হাতে সুবিধার অস্ত্র তুলে দেয়া হবে আর অন্যদিকে গণতন্ত্র এগিয়ে নেয়ার পথ হবে কণ্টকাকীর্ণ। জামায়াতকে পরিত্যাগ করে বিএনপি যদি নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির মাধ্যমে দলকে সুসংগঠিত করতে চায় তবে এর বড় সুযোগ হতে পারে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন। তাই ব্লেম গেমে সময় নষ্ট না করে ঘুরে দাঁড়ানোর পথেই হাঁটা উচিত।
সরকার দলও কি খুব স্বস্তিতে আছে? ইউনিয়ন পর্যায়ের রাজনীতিতে নিজ অবস্থান সংহত করার আকাঙ্খা অনেকেরই থাকে। নির্বাচন অভীষ্ঠে পৌঁছার মাধ্যম। তাই জায়গা সহজে ছেড়ে দিতে চাইবে না অনেকে। একারণে সরকারী দলে বিদ্রোহী প্রার্থীর ছড়াছড়ি। এদের সামাল দিয়ে দলকে সংহত করা সহজ নয়। তাই চ্যালেঞ্জ সকল দিকেই রয়েছে। এসব স্থানীয় নির্বাচনের অনুষঙ্গও বটে। তবে দলীয় দাপট নির্বাচনকে সংঘাতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। অনেক হামলা পাল্টা হামলার খবর আসছে। দিন দিন আহত নিহতের সংখ্যা বাড়ছে। নির্বাচন কমিশনের দৃশ্যমান ভূমিকা খুবই নাজুক। দেশের স্বার্থে গণতন্ত্রের স্বার্থে এমন অন্ধকার থেকে সচেতন মানুষ বেরিয়ে আসতে চায়।
এসকল বাস্তবতা মাথায় রেখে আমরা সকল পক্ষ যদি গণতন্ত্র সুসংহত করার জন্য ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনকে অবলম্বন হিসেবে মনে করতে পারি তবে একটি সুস্থ পরিবেশ তৈরি হতে পারে। সরকার ও সরকারী দলের উচিত নির্বাচন কমিশনকে নির্ভার করে দেয়া। নির্বাচন কমিশন যদি চাপমুক্ত থেকে একটি ভালো নির্বাচন উপহার দিতে পারে তবে নির্বাচনে যে ফলাফলই আসুক না কেন তাতে সরকারেরই জয় হবে। আমরা নতুন করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সোপান হিসেবে ইউনিয়ন পরিষদের একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান দেখতে চাই। সুষ্ঠু নির্বাচনই এই বিবর্ণ গণতন্ত্রে ঔজ্জ্বল্য ফিরিয়ে আনতে পারে। দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের ভালো মন্দ বিচার করার সুযোগ এবার হবে। আমরা প্রত্যাশা করবো ভবিষ্যতের প্রয়োজনে এ মূল্যায়নটি সততার সাথেই আমাদের রাজনীতিকগণ করবেন। নির্বাচনের গোলকধাঁধায় পরা বিপন্ন তৃণমূল বেরিয়ে আসুক আলোতে।
লেখক : কলামিস্ট, অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: জাগো নিউজ
Be the first to comment on "দলীয় নির্বাচনে বিপন্ন তৃণমূল"