নিউজ ডেস্ক: নার্সিং হোমের কাচের দরজাটা ঠেলে ওরা ঢুকতেই আমার নীচের চোয়ালটা আপনাআপনিই টুপ করে ঝুলে গেল। আমাদের পাড়ার মন্টাদা তার বিশাল চেহারা আর ডোন্ট কেয়ার মার্কা চোখ নিয়ে ঢুকেছে। কিন্তু তার সঙ্গে এই নতুন পিসটা কে? ফুরফুর করে ওড়া কন্ডিশনড চুল নিয়ে ফরসা, পাতলা চেহারা, জিন্স আর কালো টি-শার্ট পরা যে মেয়েটা মন্টাদার সঙ্গে এগিয়ে আসছে, তার সঙ্গে টিভিতে দেখা মডেল বা সিনেমার হিরোইনের অনায়াসে তুলনা করা চলে। আমার পেশেন্ট অ্যাডমিশনের মান্থলি রিপোর্ট মাথায় উঠে গেল। রিসেপশনে এসে মন্টাদা বলল, “কয়েকটা ব্লাড টেস্ট করাতে হবে।”
রিসেপশনের দিদি মিষ্টি হেসে বললেন, “নাম, ঠিকানা আর ফোন নম্বরটা বলুন।”
আমি আড়চোখে মন্টাদাকে দেখলাম। পাড়ারই ছেলে, কিন্তু এমন ভাব করছে যেন চেনেই না।
“নাম পামেলা সেনগুপ্ত। ঠিকানা…”
মন্টাদা এইবার দেখতে পেয়েছে আমাকে, মানে চিনতে পেরেছে। চোখটাকে ছোট করে আদেশের গলায় বলল, “এই তো পটাই, একটু দ্যাখ তো…”
অমন একটা অপ্সরার সামনে নিজের ডাকনামটা শুনে ঝট করে মটকা গরম হয়ে গেল আমার। তবু উঠে ডেটা এন্ট্রি ছেড়ে “হ্যঁা হ্যঁা” বলে প্রেসক্রিপশনটা নিয়ে ভিতরে গেলম। ল্যাব টেকনিশিয়ান ছেলেটাকে টেস্টগুলোর কথা বুঝিয়ে দিয়ে মন্টাদাদের ভিতরে বসতে বললাম। ঝট করে একবার চোখাচোখি হয়ে গেল পামেলার সঙ্গে। ওর ঠোঁটের কোণে এক টুকরো হাসি লেগে আছে না কি? আমি কি হাসব? মন্টাদা যদি দেখে ফেলে? একবার ডোডোর দোকানে কী যেন একটা ঝামেলায় মন্টাদার ঘুসিতে শোকেসের ইয়া মোটকা কাঁচ ফেটে গিয়েছিল।
পামেলা ভিতরে এসে বসল। ল্যাব টেকনিশিয়ান ব্লাড নেবে বলে সিরিঞ্জটা বের করতেই পামেলা, “ওরে বাবা, খুব লাগবে, ভীষণ লাগবে…” বলে এমন ছটফট করে উঠল, যেন ছেলেটা মুরগি কাটতে এসেছে।
আমি বললাম, “না, না, একটু পিঁপড়ে কামড়াবার মতো লাগবে, কিছু হবে না।”
পামেলা তবু মন্টাদাকে শক্ত করে ধরে বলতে লাগল, “আমি টেস্ট করাব না। কত বড় ছঁুচ, আমার খুব লাগবে।”
মন্টাদা পামেলার হাতটা ধরে বলল, “করব না বললে হবে? ডাক্তার বলেছে যখন। আচ্ছা, আমি রয়েছি, এই তো। তুমি ওই দিকে দেখবে না, চোখ বোজো, চোখ বোজো…”
কচি খুকি! আমি আর একটু এগিয়ে গিয়ে পাশে দাঁড়ালাম। ছেলেটা সিরিঞ্জ ফোটাতেই, “আউ মাগো!” ইত্যাদি বলে চিত্কার জুড়ল পামেলা। ছেলেটার পাশ দিয়ে বেরিয়ে আসা হাতটা আমার জামা খামচে ধরল। আর আমার সারা গা বেয়ে যেন ইলেকট্রিক শক বয়ে গেল। ফরসা, তুলতুলে আঙুলগুলো প্রাণপণে চেপে ধরে আছে আমার জামাটা। আমার হাত, পা দুর্বল হয়ে আসছে, কান গরম হয়ে যাচ্ছে, কপালে ঘাম জমছে। বেশ বুঝতে পারছি গলা শুকিয়ে কাঠ।
ব্লাড নেওয়া শেষ। পামেলা বিধ্বস্ত অবস্থায় একবার আমার দিকে চেয়েই হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলল, “সরি।”
আমি হেসে বললাম, “ঠিক আছে,” কিন্তু কোথাও যে কিছু একটা গোলমাল হয়ে গিয়েছে, সেটা বুঝতে বাকি রইল না। মাটিতে যেন পা পড়ছিল না। কুচকে থাকা জামাটার উপর আলতো করে হাত বুলিয়ে নিলাম, নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শুঁকলাম। হালকা মেয়েলি পারফিউমের গন্ধ লেগে থাকা শ্বাস ছড়িয়ে যেতে লাগল আমার শরীরে, মনে, আমার সবখানে।
অটোয় চড়ে বাড়ি ফিরতে-ফিরতে বারবার মনে পড়ছিল ঘটনাটা। মন্টাদার সঙ্গে এই মেয়ে কী করে লটকাল? মন্টাদা যা জিনিস, তা তো আমি জানি! গাম্বাট দ্য গ্রেট! মন্টাদা আমাদের পাড়ার, যাকে বলে মস্তান টাইপের এক দাদা। ছোট থেকেই দেখে আসছি, হেভি ডাকাবুকো ছেলে। কোন একটা কোম্পানিতে সেল্সের কাজ করে, মাইনেপত্তর যতদূর জানি, আমার মতোই। কিন্তু রংবাজিতে মন্টাদার জুড়ি মেলা ভার। ছোটবেলায় মন্টাদা আমাদের হিরো ছিল। কারও সঙ্গে মারামারি হলে বকে দেওয়ার জন্য মন্টাদা, খেলতে গিয়ে পায়ে লেগেছে, মন্টাদা পায়ে ক্রেপ জড়াচ্ছে আর বকুনি দিচ্ছে, কার বাগানে ঢিল মেরে আম পাড়তে গিয়ে জানলার কাচ ফাটিয়েছি, মন্টাদা এসে ঠাস ঠাস করে দিল ঘা-কতক। ছোটবেলার সহ্যসীমা, দাবিদাওয়া বড়বেলার সঙ্গে মেলে না। ক্রমেই মন্টাদার হিরোগিরি ফলানোটা অসহ্য হয়ে উঠল। মুখে-মুখে তর্ক করার সাহস এসে গেল। এবং ফলস্বরূপ মন্টাদার থেকে আমরা একটু দূরেই থাকতাম। আড়ালে ওকে নিয়ে হাসাহাসি করলেও সামনাসামনি কিছু করার সাহস কারও হয়নি। পাহাড়ের মতো বিরাট একটা বপু বানিয়েছে, রেগুলার জিম-টিম করে। হাঁটাচলা করলে গায়ের মাসলগুলো যেন কথা বলে। পামেলা কি সেইসব দেখেই কাত হয়ে গেল?
রাতে শুয়ে পড়ার অনেকক্ষণ পরেও ঘুম আসছিল না। জীবনে অনেক কিছু হয়নি আমার। গ্র্যাজুয়েশন করে মাস্টার্স করা হয়নি, কারণ বাড়িতে অভাব। বাবার পাশে না দাঁড়ালে চলছিল না, ছোট বোনটা সবে হায়ার সেকেন্ডারি দিল, ওর পড়াশোনাও একটা ফ্যাক্টর। একটা বাইক কেনার ইচ্ছে ছিল, সেটাও হয়ে উঠছে না। কিংবা বকাইদের সঙ্গে ফিবছর ট্রেকিংয়ে যেতাম, সেসব এখন স্বপ্ন। সেইসব না পাওয়াগুলোকে নিয়ে আমার সেরকম ক্ষোভ ছিল না, মেনে নিয়েছিলাম। আজ কেন জানি না মনে হচ্ছে, কিছুই তো পাওয়া হয়নি আমার। কোথায় কী যেন ঠিক মেনে নিতে পারছি না।
আমি দেখতে-শুনতে ভাল, যে কাউকে কথাবার্তায় পটিয়ে ফেলতে পারতাম। পটাই নামটা সেই কলেজ লাইফ থেকেই পাওয়া। কলেজের হিরো সেই পটাই হয়ে আমি… কীসব যে ভাবছি! মন্টাদার উপরে অকারণ রাগ হচ্ছে কেন, কে জানে। পামেলাকে দেখার পরেই মনে হচ্ছে, এটা হতেই পারে না। কলেজে দু’-একটা ইনফ্যাচুয়েশন ছাড়া আমার সেরকম কোনও অ্যাটাচমেন্ট ছিল না, আমিই হতে দিইনি। কিন্তু পামেলাকে দেখার পর একটু অন্যরকম লাগছে স্বীকার করছি। আমি শিওর, মন্টাদা গা জোয়ারি করে ওকে তুলেছে। ওর পক্ষে এটাই স্বাভাবিক। ওই ছেলের মধ্যে কোনওরকম আবেগ বা ফিলিংস আছে বলে তো মনে হয় না! পামেলার খামচে ধরা আঙুলগুলো যেন এখনও আমার গায়ের সঙ্গে লেগে আছে, আশ্রয় খঁুজছে, পালিয়ে আসতে চাইছে।
ডোডোর দোকানে আমাদের ঠেক। চা খেতে-খেতেও মেজাজটা খিঁচড়ে ছিল।
“এমন ডিমের পোচের মতো মুখ করে আছিস কেন রে?”
ডোডোর এইসব প্রশ্নের কোনও উত্তর হয় না। কথা বলতেই ভাল লাগছে না আমার। ডোডো দোকান থেকে মুখ বাড়িয়ে চাপা গলায় বলল, “মন্টাদার সঙ্গে যে পিসটা ঘোরে, দেখেছিস?”
আমি বললাম, “দেখে আর কী করব! বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট!”
ডোডো খ্যঁাকখ্যঁাক করে হেসে বলল, “ফ্রাস্টু খেয়ে গেলি না কি রে, হিরো? অনেকদিনই দেখছি। ওদিকে চোখ দিয়োনি বাপু, চোখ খুলে পিছনে লাগিয়ে দেবে।”
“তুই কি তা হলে চোখ বুজেই ঝাড়ি মারছিস? নিজেই তো বললি, অনেকদিন হল।”
“অনেকদিন না হলে এরকম বাড়িতে নিয়ে আসে নাকি!”
চমকে উঠে বললাম, “বাড়িতে মানে? বাড়িতে দেখাতে?”
“তবে আর বলছি কী! কথাবার্তা পাকা, এবার কার্ডটা ছাপাতে দেবে।”
আমার ঘাম হচ্ছে কেন বুঝতে পেরেও পারলাম না। চা-টা তিতকুটে লাগল, মুখটাও টকে গেল। বারবার পামেলার ‘সরি’-টা মনে পড়ছিল। শুকনো গলায় বললাম, “মেয়েরা ছেলেদের বাড়ি দেখতে আসে নাকি?”
“বাঃ, ভাল বললি তো! আমি কোথায় যাব, বাকি জীবন থাকব, সেটা দেখব না? এটা কি পুরাকাল নাকি?”
“ওর বাড়ির লোকেরা আসেনি? মানে কথাবার্তা পাকা যখন বলছিস…”
“এসেছে কি না জানি না। তব্ চিজ় একদম মস্ত। একে মন্টাদা তুলল কোথা থেকে বল তো? বেশ বড়লোকের মেয়ে বলে মনে হল।”
“ভাল জামাকাপড়ে সবাইকেই বড়লোক মনে হয়। আমিও তো কাজে যাওয়ার সময় সুটেড-বুটেড হয়ে যাই, বড়লোকের মতো লাগে না?”
ডোডো তোম্বামার্কা মুখ করে কাস্টমার সামলাতে লাগল। আমিও উঠে পড়লাম।
নার্সিং হোমের কম্পিউটার থেকে নিয়ে পামেলার নম্বরে ফোন করলাম। করলাম মানে, কেউ যেন করিয়ে দিল…
“আমি লাইফগার্ড নার্সিং হোম থেকে বলছি। আপনার রিপোর্টগুলো কখন নিয়ে যাবেন?”
ওপাশ থেকে উত্তর এল, “ওঃ! ইউ পিপল আর সো কেয়ারিং! আমি আজ বিকেলে যাই?”
“ওকে।”
চুলটা ব্যাকব্রাশ করে নিলাম, মুখের তেলতেলে ভাবটা ফেসওয়াশ দিয়ে উঠিয়ে দিলাম, জামাটা পালটে ফেললাম, একটু হালকা করে ডিও দিলাম। মুখে একটা দুষ্টু-দুষ্টু বাচ্চামি আছে আমার। আমি জানি, এটা মেয়েরা পছন্দ করে। কিন্তু কেন করছি এসব? কি হবে নিজেকে প্রেজ়েন্ট করে? কিন্তু আমার ভিতর থেকে কেউ যেন এসব করিয়ে দিল, বোধ হয় রিফ্লেক্স!
পামেলা একাই এসেছে। আমি পটাই, কলেজে স্মার্ট গাই হিসেবে আমার সুনাম ছিল। এগিয়ে গিয়ে হেসে বললাম, “হাই! আমিই ফোন করেছিলাম। একটু বসুন, আমি রিপোর্টগুলো এনে দিচ্ছি।”
পামেলা আজও জিন্স আর কুর্তি পরে এসেছে। একটা ডিসেন্ট লুক, একেবারে আলাদা টাইপ। বলল, “একটা যদি উপকার করে দেন খুব ভাল হয়।”
“অবশ্যই, বলে ফেলুন।”
“আপনাদের এখানে ডাক্তার মৈত্র আসেন। আমি ওঁকে দেখাই। চেম্বারে এত ভিড় হয়, বড্ড সময় চলে যায়। এখানে একটু দেখিয়ে দেবার ব্যবস্থা করা যায়?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, হয়ে যাবে,” আমি কনফিডেন্ট, “তবে এটা বাইরে কোথাও বলবেন না, তা হলে আমি কেস খেয়ে যাব।”
“প্রশ্নই ওঠে না। আমি কি ওয়েট করব?”
“স্যার রাউন্ডে আছেন। নীচে নামলেই আমি ডেকে নেব। ততক্ষণ বসুন।”
মৈত্রস্যার পামেলাকে দেখেই আমার দিকে চাইলেন। আমি লজ্জা-লজ্জা মুখ করে বললাম, “বিশেষ পরিচিত, স্যার।”
“আগে বলিসনি তো? উঁ?”
আমি দেখলাম পামেলার নাকের ডগা লাল। কথাবার্তা শেষে বেরিয়ে এসে পামেলা বলল, “আপনাকে যে কী বলে…”
আমি বললাম, “কী আর বলবেন! বাই দ্য ওয়ে, আমি তুহিন। মন্টাদার পাড়াতেই থাকি।”
“বিশ্বরূপের ডাকনাম মন্টা বুঝি?”
ডাকনাম বলে দেওয়ার একটা ঝাল মিটল। পটাইকুমারের এবার কথা চালাতে খুব বেশি অসুবিধে হবে না। কিন্তু থেকে-থেকে ভিতরটা থমকে-থমকে যাচ্ছে যেন। খালি কেউ প্রশ্নচিহ্ন তুলে আমার ভিতরে চেয়ে আছে। সেই প্রশ্ন বড় অমোঘ, কিন্তু আমিও যেন কোথাও নিরুপায়। কিছুতেই নিজেকে আটকে রাখতে পারছি না। এটা কি আমার স্বভাবদোষ, নাকি অন্য কোনও কেমিস্ট্রি, অত ভাবার সময় নেই। আমার বলা ‘বিশেষ পরিচিত’ নিয়ে এক চোট হাসল পামেলা। আমি বললাম, “স্যার বোধ হয় অন্য কিছু ভাবলেন। খুবই মাই ডিয়ার মানুষ উনি।”
“না হলে এত ভাল ডাক্তারি করেন কী করে! আর বললেই বা কী আসে যায়, তাই না?”
কথার ছুরিটা সযত্নে ট্যাকল করে বললাম, “ভাবলে ভাবুন না। আপনি এবার থেকে এখানেই দেখাবেন বরং। আমি যখন আছি, অসুবিধে হবে না।”
“আপনি সত্যি বড় ভাল বন্ধু হতে পারেন।”
হেসে বললাম, “ভাল বন্ধুরা আপনি আজ্ঞে করে না।”
পামেলা মিষ্টি হাসল। সেই হাসিতে কী ছিল? প্রশ্রয়? নাকি অন্য কিছু? চাইব না, চাইব না করেও কেউ যেন কোনও কিছুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে আমায়। অন্যায় হলেও সেটা ঠেকানোর ক্ষমতা আমার হারিয়ে গেছে। আর পামেলা? আমাকে বলল, “নেক্সট টাইম থেকে বলা অভ্যেস করব, কেমন?”
আমি বুঝলাম শরীরটা হালকা হয়ে উড়ে যেতে চাইছে। তখন মন্টাদার কথা মনে পড়েনি আমার। পামেলার চোখদুটো কী বলছে, আমার বুঝতে বাকি রইল না। বুকের ভিতরে একটা গুড়গুড়ে ভাব… আনন্দ? নাকি আশঙ্কা? পাত্তা দিলাম না। নিজেকে নিজের ভীষণ স্যাটিসফায়েড লাগছিল।
|| 2 ||
রেস্তরাঁর অ্যাম্বিয়েন্সটা ভাল। কোণের দিকে একটা টেবিলে আমরা বসেছি। অল্প আলোয় পামেলার মুখটা মায়াবী লাগছে। পামেলা একটা আটকে থাকা শ্বাস ফেলে বলল, “আঃ! কতদিন পরে আবার একটু বাইরে খাওয়া
হবে আমার!”
আমি বললাম, “কেন? আগে খেতে না? মন্টাদার সঙ্গে?”
“ওঃ প্লিজ়, ওই নামটা আর কোরো না তো! জাস্ট হাঁফিয়ে উঠেছিলাম। আমি একটু প্রাণ খুলে হাসতে চাই জান? তোমার কাছে সেই ওপেন স্পেসটা পাই।”
আমি চুপ করে শুনলাম। অ্যাফেয়ারই বা কেন হয়েছিল? পামেলা বলে, মন্টাদাই প্রায় পাগলের মতো জোর করে ঘটিয়েছিল। পামেলার কথার কোনও দামই ছিল না। প্রথম-প্রথম বুঝতে না পারলেও, পরে ঠিকই বোঝা গিয়েছিল। আমি বললাম, “আমি সেরকম চাপিয়ে দিতে চাই না কিছু। কিন্তু একটা অ্যাফেয়ার ব্রেক করে যাওয়ার পিছনেও তো কিছু কারণ থাকে।”
একটা বেবি কর্ন মুখে তুলে পামেলা বলল, “ওর অনেক প্রবলেম ছিল জান…”
“কী রকম?”
“এই, ওর বাড়ি, ওর কাজকর্ম।”
“সে তো সবারই থাকে। ওর বাড়িতে তুমি নিজেই যেতে চেয়েছিলে! নাকি…”
“ও-ই একদিন বলেছিল, আমার মা-বাবা খুব খুশি হবেন তোমায় দেখে।’
“তারপর? কেমন দেখলে?”
“এমনই ভালই। কাকিমা কত গল্প করলেন, খাওয়ালেন। খুব আন্তরিকও। কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম, ওই বাড়িতে আমি ঠিক পারব না। নিজের জন্য কিছু করতে গেলে হাজারটা বাধা এসে যাবে।”
আমি চুপ করে পামেলার কথা শুনছিলাম। বেশ লাগে ওর রিনরিনে গলা। এই একমাসে আমরা দু’জনকে নতুন করে চিনতে শুরু করেছি। জলের গেলাসটা তুলে খেতে যেতেই হঠাত্ চোখ পড়ল দরজার দিকে। মুহূর্তের মধ্যে শরীর দিয়ে ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল আমার। দরজায় মন্টাদা তার বিশাল চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে। ও কি ফলো করছে আমাদের? মারবে নাকি? আমাকে মারলে তো এবার পুজোয় বিসর্জনে ঠাকুরের সঙ্গে আমাকেও ফেলে দিয়ে আসতে হবে! এই রেস্তরাঁর মধ্যে একটা কেলো হবে এবার। আমি কঁুকড়ে চেয়ারের আর একটি কোনায় চলে এলাম। ইশারায় পামেলাকে দেখালাম। মন্টাদা দেখতে পেয়েছে। এগিয়ে আসছে, সর্বনাশ!
স্বভাবসুলভ দৃপ্ত ভঙ্গিতে মন্টাদা এসে দাঁড়াল। পামেলার দিকে মুখ করে সামনের একটা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল। আমি পামেলাকে দেখলাম, মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে আছে আর বেবি কর্ন খাচ্ছে নির্বিকার। কী স্টেডি মেয়ে!
পামেলা মুখ খুলল, “এখানে কী চাও?”
মন্টাদা পামেলার চোখে সোজা তাকিয়ে বলল, “একটা কথাই বলতে এসেছি… সরি।”
কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপ হয়ে গেল। আমি এখানে কেউ নই। উসখুস করার শক্তিও নেই আমার। অস্বস্তি, ভয় মিশিয়ে একটা বিচিত্র অনুভূতি হতে লাগল আমার। এসব কি এখানেই হওয়ার ছিল! মন্টাদা এখানেই এল কেন? আলাদা অন্য কোথাও তো বলতে পারত? আর, আসল অপরাধী তো আমিই! আমাকে তো মন্টাদা কিছু বলছে না। এসব ক্ষেত্রে কী করা উচিত? বয়ফ্রেন্ড হিসেবে তেড়ে উঠে ঘাড়ধাক্কা দেওয়া উচিত ? মন্টাদাকে আমি ঘাড়ধাক্কা দেব? আমার ঘাড়ে অমন মাথা আছে?
“আমার অনেক সমস্যা ছিল, পামেলা,” মন্টাদা মুখ খুলল, “আমার খারাপ লাগছে, সেই সব সমস্যা আমি তোমার সঙ্গে শেয়ার করে তোমাকে অযথা বোর করতাম, তোমার সময় নষ্ট করতাম। এই যে তুমি এখানে বসে খাচ্ছ, বা ঘুরছ, এসব করার সময় আমি পাইনি। আমার চিন্তা ছিল তোমার শরীর নিয়ে, তাই তোমার জন্য ডাক্তারবাবুর চেম্বারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেছি। আমি তো নার্সিং হোমে কাজ করি না, সামান্য সেল্সের চাকরি। দিনরাত্রি ঘোরাটাই কাজ। আমার বাড়িতে প্রচুর প্রবলেম। সেই সব প্রবলেমের পরেও আমি জানতাম আমার একটা নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা আছে। আমি ভুল জানতাম পামেলা।”
আবার কিছুক্ষণের বিরতি। পামেলা বলে উঠল, “এসব বলে কী লাভ? আমি তোমার নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা নই, এটা জানা উচিত ছিল। দিনের পর দিন তোমার সমস্যার কথা শুনতে শুনতে আমার কান পচে গিয়েছিল। তোমার বাড়ির লোকজন, কাজকর্মে কী হয়, তা আমি জেনে কী করব?”
“ঠিক, একদম ঠিক। তুমি জানবেই বা কেন? কী লাভ তোমার? আসলে আমি তো লাভক্ষতির হিসেব বুঝে রিলেশন তৈরি করি না পামেলা, কখনও করিনি। আমি আবেগে চলি, সেটাই আমার ভুল। তুমি চলে গিয়েছ, ভাল করেছ। আমার বাবার ক্যানসার, মায়ের ডিপ্রেশন, চাকরির সমস্যা, এসব আমার প্রবলেম, আমাকেই সামলাতে হবে। আমি তোমাকে রেস্তরাঁয় বসার সময় দিতে পারিনি। যারা পারে, তারা পারে। দুনিয়া তোমার জন্য ওয়েট করছে। তুমি খুব ঠিক সময়ে চলে গেলে পামেলা…”
আমি দেখলাম, আমাদের মন্টাদা, আমাদের পাড়ার ডন মন্টাদার বিশাল পাহাড়ের মতো শরীরটা কাঁপছে। মন্টাদার কথা জড়িয়ে আসছে, পাহাড়টা ভেঙে পড়ছে আস্তে-আস্তে। আমি হতবাক হয়ে দেখলাম, কারও সামনে মন্টাদা ভেঙে পড়ছে। এই প্রথম আমি দেখলাম, আমাদের ছোটবেলার হিরোকে হেরে যেতে। পামেলার এত তেজ? এমন তেজ, যে একটা পাহাড়ও গলে যেতে পারে? এই পাথরগলা জলের এক বিন্দুও কি আমার মতো ফ্লার্টের… এসব কী হচ্ছে! আমার ভিতর থেকে এই দৃশ্য কেউ মেনে নিতে পারছে না। আমি ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। এখানে এসব বলতে আসার উদ্দেশ্য কি আমিও? এই কথাগুলো কি আমার জন্যও কোনও মেসেজ এনে দিল? মন্টাদাকে ডাকতে যাব, হঠাত্ আবার “সরি” বলে ঝটিতি উঠে ও চলে গেল।
এরপরে আর কোনও কথা চলে না। কিছুক্ষণ আমরা বসে রইলাম। পামেলা বলল, “সব স্পয়েল করে দিল! এমন সিন করল! ডিসগাস্টিং!”
আমি চুপ করে রইলাম। রেস্তরাঁর আলো-আঁধারিতে পামেলার মুখটা রহস্যময় লাগছে। ফরসা পামেলার দিকে তাকিয়ে মনে হল, ওর মুখটা কাগজ দিয়ে তৈরি, ভাবলেশহীন, নিষ্ঠুর। কিচ্ছু ভাল লাগছিল না। কেন, কে জানে।
বাড়ি ফিরলাম। আমাদের বাড়ি, ছোট বাড়ি। বাবা অনেক কষ্টে তৈরি করেছিল। এখনও দেনা শোধ হয়নি। সকালে বোনের রেওয়াজ না শুনলে আমার দিন শুরু হয় না। আমার মায়ের গায়ের রান্না-রান্না গন্ধে আমার সমস্ত শান্তি লুকিয়ে থাকে। বাবার হার্টে সমস্যা আছে, বোনের গাইনির সমস্যা। আমার মনের ভিতরেও কি এই বাড়িটাই লুকিয়ে নেই? এইসব বিবর্ণতার মধ্যে পামেলাকে কল্পনা করছিলাম। কিন্তু পামেলার স্টিকার লাগানো সেই ছবিটা, কেন জানি না অসহ্য লাগছিল। কানে তখনও মন্টাদার কথাটা বারবার বাজছিল, “তুমি খুব ঠিক সময়ে চলে গিয়েছ…”
দিন তিনেক পরে, বিকেলে সিনেমায় যাব ঠিক ছিল, সেদিন সন্ধেটা নষ্ট হল। হঠাত্ পাড়ার মধ্যে একটা ব্যস্ততা লক্ষ্য করলাম। ডোডো হনহন করে যেতে-যেতে বলল, “এই যে নদের চাঁদ, একটু পাড়ার দিকেও খেয়ালটা রাখ। মন্টাদার বাবার এখন-তখন অবস্থা, উনি সেজেগুজে বেইবেই করতে চললেন!”
আমার মধ্যে কেউ ধাক্কা খেল। মুুহূর্তের মধ্যে স্নায়ু টান টান। হিরো হতে পারি, কিন্তু এমন স্বার্থপর কবে থেকে হলাম আমি? আমি, কলেজের পটাই হিরো?
নার্সিং হোমের লাউঞ্জে মাথা নিচু করে মন্টাদা চুপ করে বসে আছে। কাল রাতে মন্টাদার বাবা এখানেই ভর্তি হয়েছে। ওরা নার্সিং হোমের খরচ অ্যাফোর্ড করতে পারবে না, আবার হসপিটালেও বেড পায়নি। আমাদের নার্সিং হোমে আমি একটা কনসেশন পাই, যেহেতু স্টাফ। আমি মন্টাদার দিকে এগোলাম। আমি জানি আমি কাছে গেলে মন্টাদার ভাল লাগবে না। তবুও যাব। অপমান করুক, মারুক, বকুক, তবুও ও তো আমাদের মন্টাদা, আমাদের ছোটবেলার হিরো। তাকে এইভাবে হেরে যেতে দেখতে পারব না আমি। মন্টাদা জানে না, কেউ আমার জন্য আজ সিনেমা দেখার বায়না নিয়ে চৌরাস্তায় অপেক্ষা করে করে চলে যাবে। ফোন করতেও ইচ্ছে করেনি ওকে। আমাদের জীবনটা তো সিনেমা নয়। মধ্যবিত্তদের প্রবলেমের জীবনে ঠিক সময়ে কেউ যেমন চলে যায়, কেউ চলেও আসে। মধ্যবিত্তের হিরোরা প্রবলেমের মধ্যেই বাঁচে, হিরোইন না-ই বা থাকল!
লেখক: পুষ্কর ঘোষ
সূত্র: kolkata24x7.com

Be the first to comment on "হিরো…………"