শিরোনাম

সাইরেন : কবিতার অরণ্যে অক্সিজেন

ক. কবিতা কবিকে করে স্বপ্নময়। এরপরও কবির বেদনার অশ্রু ঝরে, সায়াহ্ণে বিকেল গলে ফোঁটা ফোঁটা সন্ধ্যা হয়। বৃষ্টির সুখালাপে কাঁপে মিথুন আবেগ। তখন মায়া হরিণীর তৃষ্ণাতুর মুখ ভেসে ওঠে। প্রেয়সীর মায়ামুখ যেন স্বচ্ছ আয়না; সহজেই নিজেকে পড়ে নিতে পারে ভুল-ভ্রান্তি, ত্রুটি-বিচ্যুতি। ঘুমহারা কিশোর দৌঁড়ে যায় দূরন্ত মাঠে। অপচয়ী সন্ধ্যা নির্ভরতার ওড়নায় জড়িয়ে ধরে শীতল মুখ। বাঁশ পাতার অনুভূতির পাওনাগুলো পাওনাই থাকে। জল পিপাসায় পদ্মপুকুর মৃদু কুয়াশায় কাঁপন তোলে। কবিতার অরণ্যে অক্সিজেন কবি সানাউল্লাহ সাগরের সাইরেন।

খ. তার কবিতার বইয়ের প্রতিটি কবিতা গদ্যের ইমেজ ও আমেজ নিয়ে সাজিয়েছে ভাবার্থের মেঘরাশি। উচ্চভাষিকতার মধ্য দিয়ে খণ্ড খণ্ড ভাব উচ্ছ্বাস স্বপ্ন কবিতালিপির মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। এ জন্য তাকে পুরোপুরি ভাষার দখল ও গভীর চিন্তর বোধ রাখতে হয়েছে। সমুদ্রের ঢেউয়ে দোলায়িত ছন্দ, পাখির কলরব প্রতিটি শব্দকুঞ্জে। মফস্বলের নির্জনতা, নান্দনিক বোধ, বাউলের বাউলিপনা কবির সতৃষ্ণ চোখে। কবি এ জায়গায় নারী ও প্রকৃতিকে ভাষার পুজারি করে অন্ধ আবেগের সুঘ্রাণ নিয়েছেন। কয়েকটি উদাহরণ-
১. নীরবতা ভেঙে কথা বলে উঠলো নিদ্রিত হাওয়া- ঝাঁঝালো আর্তনাদে বিষিয়ে ওঠা সংস্কার আবার নুইয়ে পড়লো। অবহেলার বোয়েম খুলে ছড়িয়ে দিলাম অন্ধ আবেগের সুঘ্রাণ- মাতাল জোছনা আরো মাতাল হলো- ( মাতাল জোছনা)
২. নিয়ম ভেঙে যদি চলতো জাগতিক সব উচ্চারণ- হয়তো ঝিমিয়ে কাটতো না মধ্যরাত। অসুখ ছিকায় রেখে দাঁড়িয়ে যেতাম লগ্নভ্রষ্ট কুমারীর বর সেজে। (ফেব্রুয়ারি দু হাজার তেরো)
৩. নদীর উরু কামড়ে বেদে বহর- অদূরে কচুরিপানার নিরুদ্দেশ যাত্রা। ওপাড়ে নিঃসঙ্গ বৃক্ষের তৃষ্ণার্ত জিহ্বা- আকাশের দরজায় কালো নেকাব। অন্তরালে সব্য আলো- সাথে জীবনমগ্ন বাউল। সময়ের তবলায় অসংকোচ উচ্চারণে- ( অসুখ)
৪. সাবধানে থাকিস দোস্ত- আজকাল আসমানও নাকি তোদের গেস্টরুমে- এসব ডায়লগ এই যে প্রথম শুনলাম তা কিন্তু নয়! সিঁড়ি মাপার প্রথম পরিচ্ছদেই ছিলো এমন বেসুরো সঙ্গীত। (রঙখেলা)
৫. প্রণাম নিবেন মহামান্য পাঠক- সমাজ নিষিদ্ধ এ পদ্যখানা আপনাদের হাতে তুলে নেবার সময় সাবধান। সংস্কারের দেয়াল পাশে চুপ করে থাকা অন্ধকার যেন লেপ্টে না যায় রঙমুখা পালকীতে। (নিষিদ্ধ চিরকুট)

গ. কবি সানাউল্লাহ সাগর প্রেম, জীবন, জগত- এই তিন সত্তাকে কবিতার বিষয়বস্তু করে শব্দের অলংকার পরিয়ে কখনো কখনো এর রহস্য ধরতে চান। তার কবিতার ভাষাভঙ্গি সহজ-সরল ও স্পষ্ট। উত্তম পুরুষে লেখা সকল কবিতাই ঘ্রাণময়। কবি কিছু কবিতায় পাপকে জীবনের পারদ মনে করেন। কবির পাপ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। পাপ না করলে কবিতা আসে না। মাটির প্রেম, জীবন দর্শন, প্রাণময় গ্রাম্য ছবি সবটাই তুলে এনেছেন খেয়াঘাটের নজরানায়। যেমন-
১. আবার একবার নতজানু হয়ে তুলে নিলাম ধুলায় লুটানো পাপ।… কী ছিলো চাওয়া চুম্বনের সুরে ইয়াসমিন- কিছুইতো বলোনি সেদিন। (আততায়ী)
২. দ্রাঘিমায় মাতাল জল- উচ্ছ্বল হাওয়ার মক্তব। বিকলঙ্ক মানবতার ময়দানে তাবিজের খসড়ায় বুঁদ মৌ-লোভী। (লিপটিজিং)
৩. পৌরুষ শাসানো যৌবন তাস খেলছে উচ্ছ্বলতার খোলা চাতালে- ( অদৃশ্য)
৪. ভুল হলেও সত্য শিখছি- পরাজিতের কোন ইতিহাস থাকে না। (ভুল)
৫. শীত জড়ানো সকালে উৎসুখ কুয়াশার কাঁধে স্কেচ হয়ে ঝুলানো থাকে শৈশব। (পথ)
৬. আর এখানে মেঠো পথের ধুলায় বাউলে সুঘ্রাণ। (সিলেবাস)
৭. ডানে কসাইখানে বিপদগামী আত্মা বামে শোকে বিহ্বল নরক প্রহরীর দল। (ফেব্রুয়ারি দুই হাজার তেরো)

ঘ. টিনসেট ঘরে কচুরী বাগানে জোনাক উৎসব। যে ফুটো চালে জোছনা সেই ফুটোয় বোধের অশ্রু। প্রেয়সীর টগর ফুল, বেগুনী পাপড়ির প্রেমবিলাস। দরজার কালভার্টে সাহসী প্রেমিকের প্রতিক্ষা খয়েরী বাড়ির জংধরা অলিন্দ, স্বচ্ছ জলে হীম বাতাসের কম্পন, শান বাধানো ঘাটে শতবর্ষী বটবৃক্ষ। শস্যের কপালে বিছানো ধ্যানময় চাদর মধুর ও স্বর্গীয়। তার কয়েকটি সবুজ পাতার সজীব ঝরা উজ্জ্বল পঙক্তি-
১. নিয়মিত অনভ্যাসে ক্ষয়ে যেতে বসেছে উদ্যমের বৃক্ষ। লতানো কর্মচিন্তা অলস বাহানায় নীরব। (বৃষ্টি হলে কান্না পায়)
২. যদি জানতাম-বৃষ্টিরা অসুখ মেপে আসে- ঘুমিয়ে থাকতাম শাপলার আঁচলে নির্জন কোন বিলে। (পড়শি)
৩. রূপজীবীদের ইশারায় কতোকাল মাতাল ছিলাম- ভেবে ভেবে স্থির বৃক্ষ হয়ে যাচ্ছি। ( অভ্যন্তরীণ)
৪. বিশ্বাসের ভিটে বিছিয়ে দিয়েছে সরলতার ফরাশ- প্রগতির সিঁড়ি নেচেছে তুড়িতে তুড়িতে… (সিলেবাস)
৫. সহাস্যে জেগে ওঠে অনাদরে ঘুমিয়ে থাকা চড়ুই। বিশ্বাস- অবিশ্বাসের মাঝে জোছনা- ভয়ে ছুঁই না। (নীল রাত্রির জোছনা)

ঙ. ক্লান্ত পথের জায়নামাজ কালো মেঘের কালো পাগড়ির সুখ। লোকজ আঙিনায় ঝি ঝি প্রার্থনা কাদাখোচা গাংচিলের ভালোবাসার বিল। ভোরের তটিনীর পবিত্র মন্দির। শাখার রিনিঝিনি, ধবল জোছনার মতো প্রতিমার মুখ, আজলা জলে জরায়ু রৌদ্দুর কবিতার ফাঁদে ফেলে কবি সানাউল্লাহ সাগরের রূপক ও চিত্রকল্পের মতো। তা তুলে ধরছি-
১. সিথানের ওয়ালম্যাট হয়ে বাতলে দিচ্ছেন নিকষ কালো অন্ধকারে সাদা পথের ঠিকানা। জলে ভেজা চোখ আমার দেখছে আর হাঁটছে মায়ের পিছু পিছু। (মা)
২. পরমায়ুর অভিধান থেকে হারিয়ে যাওয়া লোক সমাচার হয়ে অতিবাস্তব কলবে ভেসে বেড়ায়। (লিপটিজিং)
৩. তন্দ্রায় আচ্ছন্ন পৃথিবী ঝিমালেও ঘড়ি ঠিকই মেপে যায় অভ্যাস-অনাভ্যাসের রথ যাত্রা। (বিভ্রম)
৪. স্বপ্নের আকিবুকি ছিলো সুগন্ধি রুমালের খাটালে নিভৃত অন্ধকারে। (সকালের তরজমা)
৫. গার্হস্থ্য বিতানে চলে গেছে যেসব সমবয়সী অভিধান। তার যাতনা তোলা আছে স্বর্গের ছিকায়। (অভিভাষণ)
৬. বৈশ্বিক স্রোতে হাসি হারানো ময়ূরি নিশ্চুপ। কিছুটা অন্ধকার তারও প্রেরণা বেঁচে থাকার ভরসা। (গুহা)

কবি সানাউল্লাহ সাগরের কিছু কবিতায় অতিকথন মনে হয়। ভাষারীতিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুর্বল মনে হয়েছে। এরপরও আমি বলবো- এই গ্রন্থটি বাংলা কবিতার একটি বলিষ্ট পদক্ষেপ। চিত্রল হরিণীর মতো চারুদীপ্ত উচ্চারণ- কমায় থেমেছি তুলি হাতে ফুলস্টপ আঁকবো এবার…

Print Friendly, PDF & Email
basic-bank

Be the first to comment on "সাইরেন : কবিতার অরণ্যে অক্সিজেন"

Leave a comment

Your email address will not be published.


*